ডিজেলের বাড়তি চাহিদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বিপিসির

পেট্রলপাম্প ব্যবসায়ীদের দাবি, লোডশেডিং শুরুর পর ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধির কারণ খুঁজছে বিপিসি।

জ্বালানি তেল
ছবি: সংগৃহীত

পরিকল্পিত লোডশেডিং শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ডিজেল বিক্রি বেড়েছে। জ্বালানি তেল পরিবেশকেরা (ডিলার) বলছেন, ডিজেল জেনারেটরের ব্যবহার বাড়তে থাকায় চাহিদা বেড়েছে। সংকটের ভয়ে কেউ কেউ বাসায় মজুত করছেন। কেউ কেউ গাড়িতেও বেশি নিচ্ছেন। এখন এই বাড়তি চাহিদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো।

সরকার অনুমোদিত পরিবেশকদের নিয়মিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীনে থাকা তিন রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। এ জ্বালানি তেল কিনে নিয়ে পরিবেশকেরা নিজস্ব পেট্রলপাম্প থেকে ডিজেল, পেট্রল ও অকটেন বিক্রি করে গ্রাহকের কাছে।

পেট্রলপাম্প ব্যবসায়ীদের দাবি, এক সপ্তাহে ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর অকটেন ও পেট্রলের চাহিদা বেড়েছে ১০ শতাংশ। তাই তাঁরা বেশি হারে জ্বালানি তেলের চাহিদা দিচ্ছেন। তবে চাহিদা অনুসারে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে না বলে গতকাল সোমবার কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। সপ্তাহে ৫০ হাজার লিটারের চাহিদা থাকলে ৩৫ হাজারের বেশি দেওয়া হবে না।

রংপুরে লোডশেডিংয়ের চাপে বিক্রি বেড়েছে ডিজেলের। রংপুর শহরের স্টেশন রোডের ছালেক মটরসের ব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগে দিনে ৪০০ থেকে ৪৫০ লিটার ডিজেল বিক্রি হতো। এখন তার চেয়ে ১৫০ লিটার বেশি বিক্রি হচ্ছে। পেট্রল আগের মতোই বিক্রি হচ্ছে। তবে তাঁর পাম্পে মজুত থাকায় জ্বালানি তেলের সংকট নেই।

পেট্রল পাম্প মালিক সমিতির একাংশের মহাসচিব মিজানুর রহমানের একাধিক পেট্রলপাম্প আছে। তিনি জ্বালানি তেল কোম্পানি পদ্মা ও মেঘনার পরিবেশক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত সপ্তাহে তাঁর মাওয়া রোডের পেট্রলপাম্পে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়েছে। এ সপ্তাহে ২৭ হাজার লিটারের বেশি দেবে না বলে জানিয়েছে পদ্মা তেল কোম্পানি। অন্যরাও একই রকম কম সরবরাহের নির্দেশনা পেয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।

হঠাৎ ডিজেল ও অন্য জ্বালানি বিক্রি বৃদ্ধির কারণ খুঁজছে বিপিসি। পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনাও এটি খতিয়ে দেখছে। এ সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি পেট্রলপাম্পের নিয়মিত জ্বালানি তেল কেনার হিসাব কোম্পানির কাছে সংরক্ষিত আছে। এ থেকে প্রতিটি পরিবেশকের সপ্তাহে গড় বিক্রির ধারণা পাওয়া যায়। হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পেছনে নানা কারসাজি থাকতে পারে। তাই যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়া বাড়তি চাহিদার জ্বালানি তেল সরবরাহ না করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সরবরাহ কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে হঠাৎ করে চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার কথা নয়। হুট করে বাড়তি চাহিদা দিলে তার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তাই বাড়তি চাহিদা দিলে সরবরাহের আগে তার যৌক্তিকতা যাচাই করা হয়। এটি জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোর নিয়মিত কাজের অংশ।

আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে বেড়েছে ব্যবহার

বারবার লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে। উত্তরার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে দিনে আধা ঘণ্টাও জেনারেটর চালাতে হতো না। লোডশেডিং শুরুর পর দিনে এখন কয়েক ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। ঘাটতি ও মূল্যবৃদ্ধির ভয়ে তিনি ২৫০ লিটার ডিজেল কিনে রেখেছেন বাসায়। রাজধানীর আরেক বাসিন্দা বলেন, তাঁর ১৪তলা ভবনে দিনে এখন ৩০ লিটার বেশি ডিজেল লাগছে।

রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী একজন পরিবেশক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগে দুই দিনে তিন ড্রাম ডিজেল নিত হোটেলটি। এক সপ্তাহ ধরে দিনে তাদের লাগছে আড়াই ড্রাম ডিজেল।

গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে শিল্পে জেনারেটর

নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লা অ্যাপারেলসের তিনটি কারখানা আছে। এর দুটিতে ২ মেগাওয়াট এবং ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) থাকলেও একটিতে নেই। এ কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, দিনে গ্যাসের সরবরাহ কম। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে গড়ে। গতকালও তিন ঘণ্টা হয়েছে। তিনটি কারখানা মিলে দেড় হাজার লিটারের বেশি ডিজেল লাগছে দিনে। অথচ একসময় লোডশেডিং না থাকায় বসিয়ে রাখার কারণে একটি জেনারেটর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

শিল্পকারখানার মালিকেরা বলছেন, গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ক্যাপটিভ সব সময় চালানো যাচ্ছে না। রাত ১০টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ ঠিক থাকলে এটি চালানো যায়। এরপর বাধ্য হয়ে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। আর যাদের ক্যাপটিভ নেই, বিদ্যুৎ গেলেই জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এ কারণে ডিজেলের ব্যবহার বেড়ে গেছে।

গাজীপুরের লক্ষ্মীপুরা এলাকার স্প্যারো গার্মেন্টসের মহাব্যবস্থাপক শরিফুল রেজা প্রথম আলোকে বলেন, আগে দিনে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। কয়েক দিন ধরে গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা হচ্ছে। এতে জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দিনে ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে। আগে সপ্তাহে ৫০০ লিটার ডিজেল লাগত। এখন দিনে লাগছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৬০০ লিটার। এ ছাড়া গ্যাসের সরবরাহ কমায় কারখানায় বয়লার চালাতে দিনে আরও ৫০০ থেকে ৬০০ লিটার ডিজেল লাগছে।

স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়তি সরবরাহ নয়

গতকাল রাতে সিলেট শহরের তিনটি পেট্রলপাম্প ঘুরে জানা গেছে, ডিপোগুলো আগের মতো চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল সরবরাহ করছে না। আম্বরখানা এলাকার জালালাবাদ সিএনজি স্টেশনের ব্যবস্থাপক স্বপন কান্তি দাশ প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রতি সপ্তাহে তাঁরা ১৪-১৫ হাজার লিটার ডিজেল সংগ্রহ করতেন। এখন পাচ্ছেন ৫ হাজার লিটার।

পেট্রলপাম্পের মালিকেরা বলছেন, জ্বালানি তেলের সরবরাহ কমলে গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করা যাবে না। তাই গ্রাহকদেরও তাদের চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহ করতে হবে। এতে জ্বালানিসংকট নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। তবে বিপিসির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন, সাশ্রয়ী ব্যবহারের চিন্তা থেকেই সরকার ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কটি গত মঙ্গলবার থেকে বন্ধ রেখেছে। দেশে জ্বালানি তেলের মজুতে কোনো ঘাটতি নেই। নিয়মিত আমদানিও হচ্ছে। তাই আতঙ্কের কোনো কারণ নেই।

লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটরের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং কারও কারও বাড়তি কেনার কারণে গত সপ্তাহে ডিজেলের চাহিদা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন পেট্রল পাম্প মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে গত তিন মাসে পেট্রলপাম্পে জ্বালানি তেলের সরবরাহ ধরে সপ্তাহের গড় হিসাব বের করেছে জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলো। এই গড় ব্যবহারের চেয়ে বাড়তি চাহিদার তেল দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে তারা।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর সিলেট)