হার্টের স্টেন্টের দাম নিয়ে বিশৃঙ্খলা

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর হার্টের স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু সব রোগী এই দামে স্টেন্ট পাচ্ছেন না।

হৃদ্‌রোগের জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহৃত স্টেন্ট সরকার নির্ধারিত দামে সব রোগী পাচ্ছেন না। দাম নিয়ে বাজারে একধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বেশি দামেই স্টেন্ট কিনতে হচ্ছে রোগীদের।

আজ রোববার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা ডেকেছে। অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, নতুন করে দাম নির্ধারণের বিষয়ে সভায় আলোচনা হতে পারে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যৌক্তিকভাবে স্টেন্টের দাম নির্ধারণ করেনি। এই বিতর্কের মধ্যে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসা বিঘ্নিত হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

রক্ত চলাচল বৃদ্ধির জন্য এই রক্তনালির ভেতরে বিশেষ ধরনের ডিভাইস বা কল স্থাপন করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম করোনারি স্টেন্ট। হার্টের রিং নামে এটা বেশি পরিচিত। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৫ জনকে স্টেন্ট লাগানো হচ্ছে।

চর্বি জমে বা অন্য কোনো কারণে হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হতে পারে বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এতে মানুষ মারা যায়। রক্ত চলাচল বৃদ্ধির জন্য এই রক্তনালির ভেতরে বিশেষ ধরনের ডিভাইস বা কল স্থাপন করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম করোনারি স্টেন্ট। হার্টের রিং নামে এটা বেশি পরিচিত। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৫ জনকে স্টেন্ট লাগানো হচ্ছে।

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে জানা গেছে, হার্টের স্টেন্ট ব্যবসায়ীরা মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের তৈরি স্টেন্ট সরবরাহ করে। এই অংশ হাসপাতালে স্টেন্ট সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। ব্যবসায়ীদের আরেকটি অংশ স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। তারা ইউরোপসহ অন্য চারটি দেশে তৈরি স্টেন্ট আমদানি করে থাকে।

আরও পড়ুন

ঝুঁকিপূর্ণ হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় দিন দিন স্টেন্টের ব্যবহার বাড়ছে। স্টেন্টও উন্নত হচ্ছে। একসময় রক্তনালিতে শুধু স্টেন্ট স্থাপন করা হতো। তাতে নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেত। পরবর্তী সময়ে স্টেন্টের ওপর বিশেষ ওষুধের প্রলেপ ব্যবহার শুরু হয়। একে বলা হয় ‘মেডিকেডেট স্টেন্ট’। দেশে এখন মেডিকেডেট স্টেন্টই প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে।

২০২২ সালে সারা দেশে ৩০ হাজারের কিছু বেশি রোগীর শরীরে স্টেন্ট বসানো হয়েছে। সেই হিসাবে দেশে দৈনিক ৮২ থেকে ৮৫ জনের শরীরে স্টেন্ট লাগানো হয়।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব কার্ডিওভাসকুলার ইন্টারভেনশনের মহাসচিব অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দীন

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকেরা বলেছেন, স্টেন্টের ঘাটতির কারণে চিকিৎসা বন্ধ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্ট সরবরাহ আছে। তবে স্টেন্টের সহযোগী সরঞ্জাম বা অ্যাকসেসরিজের (যেমন বেলুন, তার) সমস্যা দেখা দিতে পারে—এমন আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর হার্টের স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা দাম নির্ধারণ করে, যা আগের চেয়ে কম। ১২ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত দামে স্টেন্ট বিক্রি করতে হবে। সাধারণ মানুষের জানার জন্য হাসপাতালের নোটিশ বোর্ডেও হার্টের স্টেন্টের দামের তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ স্টেন্ট উৎপাদন বা তৈরি করে না। ২৭টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে স্টেন্ট আমদানি করে। এসব স্টেন্ট যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীন, কোরিয়া ও ভারতে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি তিনটি প্রতিষ্ঠানের স্টেন্টের দাম বেশি। দেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্টের বাজার অর্ধেক বা এর কিছু বেশি।

স্টেন্টের বাজার

হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালিতে স্টেন্ট স্থাপনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠনের নাম বাংলাদেশ সোসাইটি অব কার্ডিওভাসকুলার ইন্টারভেনশন। সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ২০২২ সালে সারা দেশে ৩০ হাজারের কিছু বেশি রোগীর শরীরে স্টেন্ট বসানো হয়েছে। সেই হিসাবে দেশে দৈনিক ৮২ থেকে ৮৫ জনের শরীরে স্টেন্ট লাগানো হয়।

বাংলাদেশ স্টেন্ট উৎপাদন বা তৈরি করে না। ২৭টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশ থেকে স্টেন্ট আমদানি করে। এসব স্টেন্ট যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীন, কোরিয়া ও ভারতে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি তিনটি প্রতিষ্ঠানের স্টেন্টের দাম বেশি। দেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্টের বাজার অর্ধেক বা এর কিছু বেশি।

আরও পড়ুন

রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি ২০টির বেশি হাসপাতালে রোগীদের স্টেন্ট পরানো হয়। এরপর সবচেয়ে বেশি পরানো হয় চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামে ১০টি হাসপাতালে স্টেন্ট পরানো চলছে বলে চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া সিলেট, দিনাজপুর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও কুমিল্লায় একটি বা দুটি করে হাসপাতালে এই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

ব্যবসায়ীরা করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে স্টেন্টের দাম বাড়িয়েছিলেন। এতে রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েন। আমরা যৌক্তিকভাবেই দাম কমিয়েছি।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো. জুলফিকার আলী

দাম নিয়ে বিতর্ক

অ্যাবোট ভাসকুলার, বোস্টন সায়েন্টিফিক ও মেডট্রোনিক—যুক্তরাষ্ট্রের এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের স্টেন্টের দাম বাজারে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামের স্টেন্ট লাগাতে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে এখন। কমানোর আগে দাম ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২০০ টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের ৬৬ হাজার ৬০০ টাকার স্টেন্টও বাজারে আছে।

বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে কম দামের স্টেন্টের দাম ১৪ হাজার টাকা। এটি জার্মানির তৈরি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্ট সরবরাহের ব্যবসা করেন না এমন প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অভিযোগ, তাঁদের স্টেন্টের দাম বেশি হারে কমানো হয়েছে।

অ্যাডভান্স মেডিটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান আগে পোল্যান্ড ও জার্মানির দুটি স্টেন্ট সরবরাহ করত যথাক্রমে ৮০ হাজার ও ৬১ হাজার ৯২১ টাকায়। এখন দুটি স্টেন্টের দামই ৫৩ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করে দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কোন যুক্তিতে একই দাম হলো, তা ব্যবসায়ীদের কাছে পরিষ্কার করেনি অধিদপ্তর।

দাম কেন কমল

২৪ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, দাম কমানো নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়েছে অধিদপ্তর। একাধিকবার স্টেন্টের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের একটি অংশ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্ট ব্যবহারে চিকিৎসকদের আগ্রহ বেশি। তাঁরা এই স্টেন্টের ওপর বেশি আস্থা রাখতে পারেন।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক চৌধুরী মেসকাত আহম্মেদ।

চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীদের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বড় বড় হাসপাতালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেন্ট বেশি ব্যবহৃত হয়। বেসরকারি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের স্টেন্ট প্রায় সমান সংখ্যায় ব্যবহৃত হয়। সরকারি হাসপাতালে কম দামি অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের স্টেন্ট বেশি ব্যবহৃত হয়।

তবে স্টেন্টের সরবরাহ কম থাকলেও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি বলে জানিয়েছেন সরকারের জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন শীতকাল, স্টেন্ট পরানোর চাপ এখন কম। তা ছাড়া নির্বাচনের একটি আবহাওয়া চলছে। এ কারণেও মানুষ কম হাসপাতালে আসছে। স্টেন্টের কোনো সংকট এখনো দেখা যায়নি। তবে এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সমস্যা দেখা দেবে।

আমদানি দাম গুরুত্বপূর্ণ

দাম কমানো কতটা যৌক্তিক হয়েছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন বলেন, দাম কমানো যৌক্তিক না অযৌক্তিক, তা নির্ভর করছে কী দামে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে, তার ওপর।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলেছে, আমদানির ৪২ শতাংশ বেশি দামে স্টেন্ট বিক্রি করা যাবে। অর্থাৎ ১০০ টাকায় কেনা স্টেন্ট সর্বোচ্চ ১৪২ টাকায় বিক্রি করা যাবে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলেন, এমন দামে স্টেন্ট বিক্রি কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁরা তিনটি দিক তুলে ধরেছেন।

প্রথমত সরকার প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা নির্ধারণ করেছে। বাস্তবে তা কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকা বা এর অনেক বেশি দিয়ে। এর অর্থ কাগজপত্রের দামের চেয়ে বেশি দামে স্টেন্ট কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে প্রতিটি স্টেন্টের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় দামের ১১ শতাংশ। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স। এখন আবার নতুন করে দাম নির্ধারণ না করলে তাঁরা স্টেন্ট সরবরাহ করতে পারবেন না।

নতুন দামের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ১৯ ডিসেম্বর আদালতে যায়। আদালত ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে দাম নির্ধারণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে বলেছেন।

সমস্যা অন্য জায়গায়

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মো. জুলফিকার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে স্টেন্টের দাম বাড়িয়েছিলেন। এতে রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েন। আমরা যৌক্তিকভাবেই দাম কমিয়েছি।’

তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে অন্য বিষয়ে। শরীরে স্টেন্ট বা রিং লাগাতে বেশ কিছু সরঞ্জাম বা অ্যাকসেসরিজ দরকার হয়। যেমন: তার, বেলুন ইত্যাদি। যারা স্টেন্ট সরবরাহ বন্ধ রেখেছে, তারা এসব সহযোগী সরঞ্জাম বিক্রিও বন্ধ রেখেছে। সুতরাং সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেওয়ার ঝুঁকি আছে।

মো. জুলফিকার আলী বলেন, ‘তারা অনৈতিকভাবে এটা করছে। তারা রোগীদের জিম্মি করছে।’