দেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর মতো

‘সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয়: বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা। ঢাকা, ১১ জুনছবি: প্রথম আলো

স্বাস্থ্য বাজেটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর মতো। বাংলাদেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয়ে বরাদ্দ যেমন কম, জিডিপির শতাংশ হিসাবে স্বাস্থ্যে বরাদ্দও কম। বছরের পর বছর আমলাতন্ত্র স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে।

আজ মঙ্গলবার ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার ভবনে আয়োজিত ‘সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয়: বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার সমস্যা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা এ কথা বলেন। দ্য ডেইলি স্টার ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন ২১টি এনজিওদের মোর্চা সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন (সিএসও) ফোরাম যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে।

বৈঠকের শুরুতে মূল উপস্থাপনায় আইপাস বাংলাদেশের এ দেশীয় পরিচালক সৈয়দ রুবায়েত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অর্থনীতির পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশ্বের যে ২০টি দেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয়ে বরাদ্দ সবচেয়ে কম, সেই তালিকায় বাংলাদেশ আছে। এই ২০ দেশের তালিকায় একমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া বাকি ১৮টি দেশ আফ্রিকার। আর জিডিপির অংশ হিসাবে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম আফ্রিকার দেশ বেনিনে। বেনিনের ঠিক ওপরে বাংলাদেশের অবস্থান। এই তালিকায় থাকা ১০টি দেশের ৯টি আফ্রিকার। সৈয়দ রুবায়েত বলেন, ‘তালিকায় থাকা আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত’।

স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বাজেট কম থাকার কিছু ফলাফলও মূল উপস্থাপনায় তুলে ধরেন সৈয়দ রুবায়েত। তিনি বলেন, দেশে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে ৭৩ শতাংশ ব্যয় করছেন। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় এত বেশি হয় বিশ্বের আর মাত্র পাঁচটি দেশে। প্রতিবেশী মিয়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে কম। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যান। অন্যদিকে মানসম্পন্ন চিকিৎসা নিতে প্রতিবছর বহু মানুষ বিদেশ যান। ২০১৯ সালে ভারতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষের ৫৪ শতাংশ ছিলেন বাংলাদেশের।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সহসভাপতি মাখদুমা নার্গিস বলেন, আমলাতন্ত্রের কারণেই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ে না। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, কোনো কোনো প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্যের প্রয়োজনের নিরিখে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় না। বরাদ্দ হয় গতানুগতিক ধারায়। এ বছর যা বরাদ্দ হলো, বলা হয় পরের বছর তার চেয়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ বরাদ্দ বাড়াতে।

প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজনগুলো বাজেট বরাদ্দে কম গুরুত্ব পায় বলে মন্তব্য করেন হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞ ইসরাত জাহান। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী মানুষের ৪২ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগে। প্রতিবন্ধীরা অন্যদের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর কম বাঁচে। এসব ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় অন্যদের চেয়ে বেশি। তাদের অপূর্ণ চাহিদা অন্যদের চেয়ে তিন গুণ বেশি। কিন্তু স্বাস্থ্য বাজেটে তাদের কথা আলাদা করে ভাবা হয় না।

অনুষ্ঠানে একাধিক আলোচক বলেন, স্বাস্থ্য বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। কেউ বলেন, স্বাস্থ্যের বরাদ্দ সঠিকভাবে খরচ করার মতো দক্ষতা এই বিভাগের মানুষের নেই, কেউ বলেন ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈনুল ইসলাম বলেন, শিশুমৃত্যু হার বাড়তে দেখা যাচ্ছে, মাতৃমৃত্যু হার বাড়ছে না কমছে, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, মোট প্রজননহার অনেক বছর ধরে একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে—এসবের সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বাজেটের সম্পর্ক আছে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দ্য ডেইলি স্টারের এনজিও ও বিদেশি দূতাবাস বিষয়ের প্রধান তানজিম ফেরদৌস। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক কাওসার আফসানা, আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ পরিচালক শামস এল আরেফিন।