দেশের জ্বালানি খাতে রূপান্তরের অন্যতম বাধা হলো লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও অযৌক্তিক মুনাফা অর্জনের কাঠামো। এই পরিস্থিতি শুধু জ্বালানি সুবিচারকেই ব্যাহত করছে না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্যারিস চুক্তি ২০১৫ বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, নৈতিক ও ন্যায্যতারও প্রশ্ন।
বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। ‘বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪’ শীর্ষক জ্বালানি সুবিচার ও নিরাপত্তাবিষয়ক সভাটি আয়োজন করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ভোক্তাবান্ধব জ্বালানি খাত ও জ্বালানি সুবিচার প্রতিষ্ঠাসহ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে ক্যাব এই জ্বালানি রূপান্তর নীতি প্রস্তাব করেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা ভবন নির্মাণে যতটা আগ্রহী, গবেষণায় ততটা আগ্রহী নন। তিনি বলেন, সারাক্ষণই সমস্যা আসে। তাঁরা সমাধানের চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু সমস্যা যেন না আসে, তার জন্য যে গবেষণা দরকার—তাতে সরকার, দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় ও আমলাতন্ত্রের প্রচুর ঘাটতি আছে।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন আরও বলেন, মৌলিকভাবে ফ্যাসিবাদী, লুণ্ঠনকারী সরকারকে রক্তের বন্যায় বিদায় করা হয়েছে। কিন্তু সবাই নিজেকে কি খুব পাল্টেছে? অনেকে বলে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে ভোক্তাদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিনিধি কিন্তু আছে। ভোট দিয়েই তাঁদের প্রতিনিধি বানানো হয়। অথচ সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দালালচক্র নিয়ন্ত্রণসহ বড় অপকর্মও তাঁরাই করেন। ভুল স্বীকার করে ভালো মানুষ হয়েই এর সুরাহা করতে কবে। অন্য সব পেশাকে চোর বলে, খারাপ বললেও তারা কিন্তু নিজের দিকে তাকায় না। নিজেদের ভালো হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে নাগরিক সমাজের আওয়াজ জারি রাখতে হবে। কারণ, কথা বললে কিছু কাজ হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের মস্তিষ্ক একসময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে দিয়েছিলাম, এখন মস্তিষ্ক দিয়েছি ভার্চ্যুয়াল ওয়ার্ল্ডকে। এর কিছু ক্যারেক্টার (চরিত্র) আমাদের মস্তিষ্ককে তাড়িত করে। তার বিপরীতে ক্যাবের এ রকম চর্চায় শিক্ষার ম্যাচিউরিটি সম্ভব। শিক্ষার্থীর কাজ শুধু ক্লাসরুমের পড়া কিংবা রেজাল্ট নয়, চিন্তার পরিপক্বতাও দরকার।’
তানজিমউদ্দিন আরও বলেন, কিছু মানুষ এনার্জি সেক্টরকে (জ্বালানি খাতকে) একদম লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। সঙ্গে ছিল দেশীয় লুণ্ঠনমূলক মূল্য কিংবা দুর্নীতি করে অর্থ পাচার বা অর্থ নিজের পকেটে নেওয়া। জড়িত ছিল বিদেশি গোষ্ঠীও। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের আঁতাত তৈরি হয়েছিল। এই সেক্টর জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দুটো মাস্টারপ্ল্যান হয়েছে। সেই মাস্টারপ্ল্যানও করেছে বিদেশি সংস্থা। অর্থাৎ, দেশের জাতীয় ডকুমেন্ট তৈরি করেছে বিদেশি কোম্পানি। শুধু বিদেশি নয়, সেই বিদেশি কোম্পানির জীবাশ্ম জ্বালানি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিনিয়োগ আছে, স্বার্থও আছে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা দূষণ ও দুর্নীতিমুক্ত জ্বালানির কথা বলি। আজ শিক্ষার্থীদের আলোচনারও মূল বিষয় ছিল লুণ্ঠন। লুণ্ঠন দুর্নীতির মাধ্যমেই করা হয়েছে। আর দুর্নীতি কাঠামোগতভাবে সুশাসনকে সংকটে ফেলেছে। এটা ঘটেছে রাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। এখন রাষ্ট্রের সংস্কার হয়তো হচ্ছে। সেটা যুবসমাজের উত্থানের কারণেই হয়েছে।’
শামসুল আলম আরও বলেন, সরকার রাজস্ব আয় করবে। বড় বড় বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, বড় উন্নয়নের কাজ করবে। কিন্তু কোনো খাতকে বেসরকারি করে, তাদের মালিকানা দিয়ে ব্যক্তি খাতের ব্যবসা বানানোতেই আপত্তি। তাঁরা চান, সরকার জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে সেবা নিশ্চিত করবে। ব্যক্তি খাত সেখানে ব্যবসা করতে পারে ঠিকাদারির মতো। কিন্তু মালিকানা নয়। সেবা খাত হিসেবে জ্বালানি খাতকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পুনর্বহালের প্রস্তাব করা হয়েছে এই নীতিতে।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০ ভাগ এনার্জি যেন সৌরবিদ্যুৎ থেকে আসে, তার জন্য কাজ শুরু হয়েছে। ইউজিসির তত্ত্বাবধানেই কাজ চলছে। বিদ্যুৎ ব্যবহারেও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতামূলক কাজ শুরুর পর প্রায় ৫ ভাগ বিদ্যুৎ ব্যবহার কমেছে।
ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি–২০২৪ এই খাতে একটি সমন্বিত ও বিকেন্দ্রীকরণভিত্তিক পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে। তবে এ নীতি বাস্তবায়নে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার। বাংলাদেশে এনার্জি বা জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিতর্কিত প্রক্রিয়া রয়ে গেছে, সেটাও আলোচনায় উঠে আসে।
সভাপতির বক্তব্যে ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ মো. মঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার বলেন, ক্যাবের কাজ পরম্পরা তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উত্তরাধিকার তৈরি।
শিক্ষার্থীরা যখন রাষ্ট্রের হাল ধরবে, সে যেন বোঝে যে বিদ্যুৎ তার অধিকার। আজকে আলোচনায় নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা এসেছে। কিন্তু ভুল বুঝলে এখন তো ঠিক কাজটা করতে হবে। সরকারের সেই ইচ্ছা থাকলে, বেশি সময় কিন্তু লাগে না।
এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাতজন শিক্ষার্থী ‘জ্বালানি সরবরাহে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা’, ‘মূল্যহার নির্ধারণে ভোক্তা ও বিইআরসি’, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা সংরক্ষণে বিনিয়োগ ও মূল্যহার’, ‘জ্বালানি খাত উন্নয়নে সুবিচার সংকট’, ‘জ্বালানি ইউটিলিটিসমূহের সেবানীতি ও পরিচালনা পদ্ধতি’, ‘সরকারি ও বেসরকারি লাইসেন্সিদের নিয়ন্ত্রণে বিইআরসি’, ‘জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে বিচার বিভাগ’ বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেন।