‘অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, কীভাবে চললে স্তন ক্যানসার হবে না। আমি বলি, জন্মগ্রহণ না করলে হবে না! যেহেতু আপনি জন্মগ্রহণ করেছেন, তাই আপনার এ ধরনের ঝুঁকি থাকবেই। কারণ, দেশে প্রতি নয়জন নারীর মধ্যে সাধারণত একজনের স্তন ক্যানসার হয়ে থাকে। সুতরাং জানতে হবে কারা ঝুঁকিতে আছেন? তাঁরা হলেন যে নারীদের নির্দিষ্ট বয়সের আগেই ঋতুস্রাব শুরু হয়, অবিবাহিত, ৩০ বছর বয়সের পর সন্তান নেন, কায়িক শ্রম করেন না, দেহের স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করেন না, বংশের কারও এ ক্যানসার ছিল, অ্যালকোহল গ্রহণ করেন, ফল-সবজি খেতে চান না ইত্যাদি। এ বিষয়গুলোই যখন একজন নারী এড়িয়ে চলবেন, তাঁর স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।’
বলছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক এবং ক্যানসার–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন। এসকেএফ অনকোলোজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় অতিথি হয়ে কথা বলেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন মো. মোয়াররফ হোসেন। ১ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।
অক্টোবর মাস, স্তন ক্যানসার নিয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতার মাস হিসেবে পালিত হয়। তাই অনুষ্ঠানের শুরুতেই দিবসটির পেছনের গল্প তুলে ধরেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালে আমেরিকার কিছু স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক সংস্থা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা মানুষের মধ্যে স্তন ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করবে। মাস ছিল অক্টোবর, সেই থেকে বিশ্বব্যাপী এটাকে স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস হিসেবে পালন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল স্তন ক্যানসার নিয়ে সতর্কতা, এর প্রতিরোধব্যবস্থা, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণ পদ্ধতি ও সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা। এ ছাড়া এ মাস উপলক্ষে বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, যা স্তন ক্যানসারবিষয়ক গবেষণায় ব্যয় করা হয়।
স্তন ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, ‘স্তনে ব্যথাহীন গোটা, স্তনের স্কিন বা চামড়া দেবে যাওয়া, লালচে রং ধারণ করা ইত্যাদি। তবে এসব লক্ষণ দেখা দিলে শুরুতেই দুশ্চিন্তার কারণ নেই। অনেক সময় হরমোনজনিত সমস্যায়ও এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রতি মাসে স্ক্রিনিং করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। অবহেলা করলে এটি ছড়িয়ে মস্তিষ্ক, ফুসফুস, হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে চলে যেতে পারে।’
স্ক্রিনিং কী? সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশনটা কখন থেকে শুরু করতে হয়? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন জানান, স্ক্রিনিং এবং সেল্ফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন ২০ বছর বয়স থেকেই শুরু করা উচিত। এর উপযুক্ত সময় হলো মাসিক শুরু হওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে। দুটিই স্তন ক্যানসারকে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণে বেশ কার্যকর।
উপস্থাপক জানতে চান, মেমোগ্রাম কী এবং এটি কখন করাতে হয়? অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, ‘এটা হলো সফট এক্স-রে, যা দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত করা যায়। বিদেশে এটা ৪০ বছর পার হওয়ার পর বছরে একবার করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে ৩০ বছরের পরই করা উচিত। আমাদের দেশে ধাপ অনুসরণ করা হয়। সাধারণত সেল্ফ ও ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশনে যদি কিছু ধরা পড়ে, তবেই আমরা পরবর্তী ধাপ মেমোগ্রামে যেতে পারি।’
ক্যানসার শনাক্তকরণে কোন পরীক্ষা বেশি কার্যকর—এফএনএসি নাকি কোর বায়োপসি? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, কোর বায়োপসি। কারণ, এর সুবিধা হলো রোগীর ‘ইআর’, ‘পিআর’ এবং ‘হার-টু’ করা যায়। তিনটির ফলাফল যদি নেগেটিভ হয়, তাহলে এ ক্যানসার মারাত্মক। তাই এসব রোগীকে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
স্তন ক্যানসারের চিকিৎসাপদ্ধতি এবং দেশ ও বিদেশের মধ্যে চিকিৎসাব্যবস্থার পার্থক্য সম্পর্কে অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসাপদ্ধতি সারা বিশ্বে একই। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চিকিৎসা করে থাকি। স্তন ক্যানসার চিকিৎসার চারটি মডালিটি বা পদ্ধতি রয়েছে। অপারেশন বা সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে স্তন ক্যানসার অন্যান্য সাধারণ রোগের মতোই মনে হবে।’
আলোচনার এ পর্যায়ে উপস্থাপক জানতে চান কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির তুলনামূলক কার্যকারিতা সম্পর্কে। জবাবে অধ্যাপক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্ত হলে আমরা সার্জারি করে ফেলি। তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তাঁর রেডিওথেরাপি লাগবে কি না। কারণ, সার্জারির পর যদি দেখা যায় সেখানে টিউমারের মার্জিন এখনো রয়ে গেছে, তাহলে রেডিওথেরাপি দিয়ে থাকি। আর কেমোথেরাপি হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা। শরীরে যখন মাইক্রোস্কপিক সেল থেকে যায়, সেগুলোকে মারার জন্যই কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। সুতরাং চিকিৎসকের পরামর্শ এবং রোগের পর্যায় অনুসারেই এগুলো প্রয়োগ করা হয়।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট হলো এসকেএফ অনকোলোজি। এর ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে এবং দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া এসকেএফ অনকোলোজির সারা দেশে রয়েছে ৩৩টি সেবাকেন্দ্র, যার মাধ্যমে ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, ঘরে বসে অর্ডার করলেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হয়।