ফরম পূরণ করেছি গোপনে, টাকা দেন এক শিক্ষক

দরিদ্র পরিবারের কিশোরী শিখা খাতুন নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্যবিবাহের শিকার হয়। যৌতুকের জন্য তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। এ কারণে বিয়ের এক মাসের মাথায় বিচ্ছেদও হয়ে যায়। তখন নতুন করে পড়াশোনা শুরু করে সে। এবার এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে শিখা। এইচএসসিতে পড়াশোনার খরচ জোগাতে সে গ্রামের ২০টি শিশুকে পড়ানো শুরু করেছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার উত্তর মনিগ্রামের এই অদম্য মেধাবীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

শিখা খাতুন

প্রশ্ন :

এত লড়াই করে পড়াশোনা করে জিপিএ-৫ পাওয়ার অনুভূতিটা কেমন?

শিখা খাতুন: অনুভূতি তো অবশ্যই সুখের। বৈবাহিক জীবনের লড়াইয়ে নামতে না হলে পরীক্ষার ফল আরও একটু ভালো হতো।

প্রশ্ন :

এই লড়াই করার মানসিকতাটা কীভাবে তৈরি হয়েছিল?

শিখা খাতুন: টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অনেকের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের গল্প শুনেছি। দেখে আমার মনে হয়, ওরা যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে আমিও পারব। সেই থেকে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি।

প্রশ্ন :

বিয়ের জন্য পরিবারে এত তাড়া কেন ছিল?

শিখা খাতুন: আমার এক প্রতিবেশী কিশোরীর বিয়ে হয় ২০২০ সালের ১৫ মে। সে আমার চেয়েও ছোট। তা দেখে আমার পরিবার দুই দিনের মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। ১৭ মে আমার বিয়ে হয়।

প্রশ্ন :

শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কি পড়াশোনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে?

শিখা খাতুন: করেছিলাম। শাশুড়ি বলেছিলেন, মেয়েমানুষ, পড়াশোনা করে কি চাকরি করতে যাবে যে আরও পড়তে হবে। পড়াশোনার
দরকার নেই।

প্রশ্ন :

শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময়ই তো নবম শ্রেণির নিবন্ধন করতে হয়েছিল। সেটা কীভাবে করেছিলে?

শিখা খাতুন: আমি পড়াশোনা ছাড়ার কথা কখনোই ভাবিনি। নিবন্ধন করার জন্য আমি একটা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বিদ্যালয়ে উপবৃত্তির টাকা দিচ্ছে। যেতে হবে। এই বলে বাবার বাড়িতে এসে গোপনে প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক শিরিনা কাকির কাছে নিবন্ধন করার কথা বললাম। তিনি বরাবরই আমাকে সহযোগিতা করে আসছিলেন। নিবন্ধনের দেড় হাজার টাকা তিনিই দিলেন। বিদ্যালয়ে গিয়ে নিবন্ধন করলাম।

প্রশ্ন :

বিচ্ছেদ কেন হয়েছিল?

শিখা খাতুন: যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, তিনি একজন রাজমিস্ত্রি। বিয়ের পর তিনি ৫০ হাজার টাকা যৌতুক চাইলেন। আমার ভ্যানচালক বাবা সেই টাকার জোগাড় করতে পারলেন না। এক মাসের মাথায় সংসার ভেঙে গেল।

প্রশ্ন :

পরে আবার পড়াশোনা শুরু করার ব্যাপারে মা–বাবা আপত্তি করেননি?

শিখা খাতুন: না। তখন তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও উৎসাহ দিলেন। আবার পড়াশোনা শুরু করলাম। এখন বিয়ের কথা কেউ বললে মা–বাবা বলেন, ‘আগে মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক। তারপর নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করুক, এটাই আমরা চাই।’

প্রশ্ন :

২০টি শিশুকে পড়িয়ে কত টাকা পাবে?

শিখা খাতুন: প্রত্যেকের পরিবার ৫০ টাকা করে দেবে। সব মিলিয়ে এক হাজার টাকা হওয়ার কথা। দেখা যাক, কী হয়।

প্রশ্ন :

পড়াশোনা করে কী হতে চাও?

শিখা খাতুন: আমার তো চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা। তবে আমার শিরিনা কাকি চান, আমি এইচএসসি পাস করে যেন বিএসসি নার্সিংয়ে ভর্তি হই। তাহলে তাড়াতাড়ি চাকরি পাওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত এসব ভাবনার মধ্যেই আছি।

প্রশ্ন :

জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলে প্রথম কাজ কী হবে তোমার?

শিখা খাতুন: প্রথম এবং শেষ বলে কোনো কথা নেই। আমি বরাবর অসহায় মানুষের পাশে থাকতে চাই।

প্রশ্ন :

তোমার এই সাফল্যের জন্য কাউকে ধন্যবাদ দিতে চাও?

শিখা খাতুন: অবশ্যই। আমার প্রতিবেশী শিরিনা কাকি, ইসমত আরা দাদি, আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্য একটি বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক আনিসুর রহমান, যিনি আমাকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা পয়সায় গণিত পড়িয়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিতে চাই।