ক্যানসার দিবসের অনুষ্ঠান থাকায় চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত পাঠানো হলো রোগীদের
ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতি মাসে একবার করে কেমোথেরাপি নিতে হয় শাহ আলম নামের বয়োজ্যেষ্ঠ এক ক্যানসার রোগীকে। গতকাল সোমবার নির্ধারিত তারিখে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ চিকিৎসককে দেখাতে যান তিনি। সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতালে পৌঁছে চিকিৎসাপত্রের ফাইল জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে বেলা একটা পর্যন্ত বসে থাকলেও চিকিৎসক দেখেননি তাঁকে। তাঁকে বলা হয় পরদিন মঙ্গলবার যেন আবার আসেন। সে অনুযায়ী আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টায় পুনরায় হাসপাতালে যান এই বয়োবৃদ্ধ রোগী।
বেলা সোয়া একটার দিকে শাহ আলমকে ডেকে ফাইল ফিরিয়ে দেন হাসপাতালের একজন কর্মী। আজও চিকিৎসক দেখাতে পারেননি তিনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এই রোগী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল তো পাইনি, আজকে পাব আশা করেছিলাম। কিন্তু আজকে নাকি ক্যানসার দিবস। এরা আমাদের চিকিৎসা না দিয়ে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। এত কষ্ট করে এখানে এসে চিকিৎসা না পেলে হতাশ লাগছে, তা ছাড়া যাতায়াতেও অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। এদের কাছে আমাদের কষ্টের কোনো গুরুত্ব নেই।’
শুধু শাহ আলম নয়, মহাখালীর ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিতে এসে এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন বহু রোগী। শুধু দোতলার একটি কক্ষ থেকে চিকিৎসা না পেয়েই বিরসবদনে ফিরতে হয়েছে অন্তত ১৫০ জন রোগীকে। এর মধ্যেই হাসপাতালটি আজ বেশ ঘটা করে আয়োজন করেছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস।
আজ সকাল ১০টার দিকে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় ২২৩ নম্বর কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় ২০০ জন রোগী ও রোগীর স্বজন অপেক্ষা করছিলেন। মাঝখানে পাতা একটি টেবিলের ওপর শ দেড়েক রোগীর ফাইল রাখা আছে। ১০টা ৪০ মিনিটে ২২৩ নম্বর কক্ষে ঢুকে কয়েকজন নার্সকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাঁদের কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চান, অপেক্ষমাণ রোগীদের কখন দেখবেন চিকিৎসকেরা। জবাবে একজন নার্স বলেন, এখন পর্যন্ত একজন চিকিৎসক এসেছেন। বাকিরা (৫ জন) এলে চিকিৎসা শুরু হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি নেওয়া রোগীদের ২২০, ২২১ ও ২২২ নম্বর কক্ষ থেকে চিকিৎসা পরামর্শ দেন ছয়জন চিকিৎসক। তবে আজ দুপুর পর্যন্ত ২২২ নম্বর কক্ষে শুধু দুজন চিকিৎসক ছিলেন। তাঁরাও ওই কক্ষে এসেছেন বেলা ১১টার দিকে। বেলা দুইটা পর্যন্ত তাঁরা কিছু রোগীকে কক্ষে ডেকেছেন ও চিকিৎসা পরামর্শ দিয়েছেন।
বেলা সোয়া ১১টার দিকে ২২৩ নম্বর কক্ষের সামনে রোগীদের ফাইল জমা নিচ্ছিলেন আবদুল আহাদ নামের একজন কর্মী। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, চিকিৎসকেরা কখন আসবেন। তিনি বলেন, ‘স্যাররা অনুষ্ঠানে আছেন। আসবেন উনারা। আমাকে বিরক্ত করবেন না।’
সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ৫০০ শয্যার এই সরকারি প্রতিষ্ঠানে সারা বছর ক্যানসার রোগীর ভিড় থাকে। প্রতিদিন এক হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন।
সাভার থেকে গতকাল সকাল ১০টার দিকে এসে চিকিৎসা না পেয়ে দুপুরে ফিরে যেতে হয় রোগী আবদুল জব্বারকে। এরপর পুনরায় আজ ভোরে রওনা দিয়ে সকাল আটটায় হাসপাতালে পৌঁছে ব্যবস্থাপত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফাইল জমা দেন তিনি। বেলা ১১টার দিকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল থেকে ঠায় বসে আছি। এত কষ্ট এখানে। শরীর ভেঙে পড়েছে। এখনো ডাক্তার আসে নাই। এদের কিছু জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দেয় না, দুর্ব্যবহার করে।’
মো. শরীফ নারায়ণগঞ্জ থেকে তাঁর মাকে নিয়ে এসেছেন ভোর সাতটায়। দুপুর পৌনে একটার দিকে রোগীর ফাইলের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাই, ১ হাজার ২০০ টাকা খরচ করে সেই ভোর ৭টায় আসছি। এখনো দাঁড়ায়ে আছি। ডাক্তারের খবর নাই। হেরা নাকি অনুষ্ঠান করতাছে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে ছ্যাঁৎ করে উঠে।’
দুপুরে ১২টা ৪৮ মিনিটে আবদুল আহাদ নামের হাসপাতালের ওই কর্মী অপেক্ষমাণ রোগীদের ফাইল ফেরত দেওয়া শুরু করেন। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্তত ১৫০ জন রোগী। সবার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ভাই, আমাকে মাফ করেন। মাত্র একজন স্যার ভেতরে আছেন। এতগুলো ফাইল দেখা সম্ভব নয়। ফাইল ফিরিয়ে দিচ্ছি। একজন একজন করে চলে যান। দয়া করে কোনো ফাউল টক করবেন না।’
১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রসহ ফাইল ফিরিয়ে দিতে দেখা যায়। তাঁদের সবাইকে বলা হয়, পরদিন সকালে যেন আসেন। আরও অনেকেই তখন ফাইল ফেরত নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন।
দেলোয়ার হোসেন নামে সত্তরোর্ধ্ব একজন রোগীকে নিয়ে তাঁর স্বজনেরা চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলা থেকে এসেছেন। দেলোয়ারের চারটি কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই দিন ধরে পেটের ব্যথা সইতে না পারছেন না। হাসপাতালের চেয়ারে বসেই বারবার ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন। দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে। চাঁদপুরে এক ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলাম। উনি বললেন, যেন দ্রুত ঢাকার এই হাসপাতালে আনি। কিন্তু এখানে তো ডাক্তারই নাই।’ এরপর বেলা একটার দিকে দেলোয়ারের ছেলেকে ডাক দিয়ে তাঁর কাছে রোগীর ফাইল ফিরিয়ে দেন হাসপাতালের ওই কর্মী। তাঁদেরও আগামীকাল সকালে আসতে বলা হয়।
রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক জাহাঙ্গীর কবির আজ বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকে আমাদের অনুষ্ঠান ছিল। সহকারী উপদেষ্টা, দুজন সচিব এসেছিলেন। এ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু রোগীদের তো চিকিৎসা ছাড়া ফেরত দেওয়ার কথা নয়। আমি বিষয়টি দেখব।’