যেভাবে শুরু আবাসনশিল্পের যাত্রা
‘ধন নয় মান নয়, একটুকু বাসা, করেছিনু আশা।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আশা’ কবিতার পঙ্ক্তি। একটি লাইনেই কবিগুরু কত কথাই-না বলে ফেলেছেন! নিজের একটা ছিমছাম আবাস যে মানুষের কত আরাধ্য, তা এই পঙ্ক্তিতেই বোঝা যায়।
প্রাচীনকালে আদিম মানুষেরা পাথরের গুহায় বসবাস করত। সেখান থেকে কালের বিবর্তনে আবাসনশিল্পের উদ্ভব হয়েছে। মানুষ তার অবিশ্বাস্য বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গড়ে তুলেছে আবাসিক এলাকা, শহর ও সুউচ্চ অট্টালিকা। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন বাসস্থান এখনকার যুগে চলে গেছে শিল্পের পর্যায়ে।
মানুষ কখন থেকে আবাসনের প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করল?
শুরুটা যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও ৩০ হাজার বছর আগে। মানুষ তখন ধীরে ধীরে সভ্য হতে শুরু করেছে। বন্য প্রাণী শিকার করা ছেড়ে মনোযোগ দিয়েছে চাষবাসে। শিকারি থাকা অবস্থায় মানুষের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থানের প্রয়োজন ছিল না। তারা যাযাবরের মতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াত। কিন্তু কৃষিব্যবস্থার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন দেখা দিল আবাসনব্যবস্থারও। উর্বর জমির আশপাশের এলাকায় মানুষ ঘরবাড়ি বানাতে শুরু করল।
এই জমিগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের জন্য তখন গোষ্ঠীভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। প্রতিটি গোষ্ঠী থেকে এই নেতারাই জমি বেচাকেনা ও বণ্টনের দায়িত্বে থাকতেন।
আঠারো শতকের শুরুর দিকে ইউরোপ ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলোয় বইতে শুরু করে শিল্পবিপ্লবের হাওয়া। এই বিপ্লব অর্থনীতিকে কৃষিনির্ভরতা থেকে সরিয়ে কলকারখানা ও যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদনের দিকে নিয়ে আসে। কৃষকেরা কৃষিভিত্তিক কাজকর্ম ছেড়ে বিভিন্ন কলকারখানাভিত্তিক পেশায় ভিড়তে শুরু করেন। ঠিক ওই সময়ই মানুষের মধ্যে ‘ক্লাস’ বা শ্রেণিবিষয়ক একটা ধারণা চলে এসেছিল। সম্পদের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে সমাজে গোষ্ঠীভিত্তিক বিভাজন হতে শুরু করে। উদ্ভব হয় ব্লু কলার, হোয়াইট কলার, রেড কলার নামের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য কলকারখানার আশপাশে গড়ে উঠতে শুরু করে আবাসিক এলাকা। যাঁরা একটু উঁচু শ্রেণির মানুষ ছিলেন, তাঁদের জন্য গড়ে ওঠে সুন্দর সব ডুপ্লেক্স ও একতলা বাড়ি। মধ্য ও নিম্নবিত্তরা বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলোয় বাণিজ্যিক স্পেসের জন্য নির্মিত হয় আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্র্যাপারস।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের দিকে। এখানে কীভাবে প্রসারিত হলো আজকের আবাসনশিল্প? গোড়াপত্তনটা ঠিক দেশভাগের পরই। ১৯৪৭ সালে ঢাকা হয় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। জীবিকার খোঁজে, জীবনের প্রয়োজনে মানুষ ঢাকা শহরের দিকে আসতে শুরু করে। তখন ঢাকা শহরে পরিকল্পিতভাবে আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য গঠিত হয় ‘ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ বা ডিআইটি।
জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠে আবাসিক এলাকা। স্বাধীনতার পর উত্তরা ও বসুন্ধরার মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানি এই এলাকার জমিগুলো কিনে দৃষ্টিনন্দন সব আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে; যদিও বাংলাদেশে শুরুর দিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্মিত স্থাপনার সংখ্যাই বেশি ছিল।
গুলশান, বনানী ও বারিধারার মতো এলাকায় জমির দাম তুলনামূলক বেশি। কারণ, স্বাধীনতার পরপর অবস্থানগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার কারণে এসব এলাকার জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বাড়তে শুরু করে। আর অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকার জন্য সব উপাদানই এসব এলাকায় বিদ্যমান। এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরের ‘হটস্পট’ হিসেবে এই এলাকাগুলোকেই গণ্য করা হয়।
বর্তমানে আবাসনশিল্প অনেক আধুনিক হয়েছে। মানুষের জীবনযাপনের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা দরকার, তার সবই থাকে এখনকার বাড়িগুলোয়। ভবিষ্যতে কেমন দাঁড়াবে এই শিল্পের অবস্থা?
উন্নত আবাসনের চাহিদা বিশ্বে ও বাংলাদেশে যেভাবে বাড়ছে, চিত্রটি মাথায় রেখে চিন্তা করলে অনেকগুলো বিষয় উঠে আসে। একটা সময় আবাসনশিল্পের গ্রাহক ছিলেন শুধুই উচ্চবিত্তরা। ধীরে ধীরে এ শিল্পে গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হচ্ছেন মধ্যম আয়ের মানুষও। বিভিন্ন ব্যাংকের লোন ও ইএমআই–সুবিধা আবাসনশিল্পকে সব ধরনের গ্রাহকের হাতের নাগালে নিয়ে আসছে।