সব আপত্তি উপেক্ষা করে রেলওয়ের সেই জমিতে বিপণিবিতান

সরকারের পরিকল্পনায় রেলের জমিটিতে পরিবহনকেন্দ্র নির্মাণের কথা। রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট তৈরি করছে বিপণিবিতান। আপত্তি মেয়রের।

বাংলাদেশ রেলওয়ে (কর্মচারী) কল্যাণ ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হচ্ছে ভবন। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায়ছবি: দিনার মাহমুদ

নারায়ণগঞ্জের মানুষের সহজ যাতায়াতের জন্য প্রকল্প নিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি জমি নির্ধারণ করা আছে অনেক বছর আগে থেকে। কিন্তু মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনায় না নিয়ে সেই জমিতে বিপণিবিতান তৈরি করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে (কর্মচারী) কল্যাণ ট্রাস্ট।

সাড়ে তিন বিঘার মতো আয়তনের জমিটিতে মাল্টিমোডাল হাব (কেন্দ্র) নির্মাণের কথা। অর্থাৎ সেটি হবে রেল, নৌ ও সড়কপথে চলাচলের একটি কেন্দ্র। সেই জমিতে বিপণিবিতান তৈরি হলে রেলওয়ে কতটা লাভবান হবে, রেলওয়ে কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট কী কী সুবিধা পাবে, দোকানগুলো কত টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হবে, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক সাদরুল হকের দপ্তরে গিয়ে, মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে, খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

জমিটি নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের ঠিক পশ্চিম পাশে। এই জমি মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করা আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ)।

অবশ্য রেলওয়ে ও ঠিকাদার সূত্রের দাবি, বিপণিবিতানের ৮০ বর্গফুটের প্রতিটি দোকান থেকে রেলওয়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ পাবে ১ লাখ ৪১ হাজার টাকা। কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট বছরে ভাড়া পাবে মাত্র ১৬ হাজার টাকা। মোট দোকানের অর্ধেক বরাদ্দ পাবেন রেলওয়ে কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যরা। বাকি অর্ধেক পাবে নারায়ণগঞ্জের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একটি সমিতি। যদিও একেকটি দোকান ২৫-৩০ লাখ টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জমিটি নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের ঠিক পশ্চিম পাশে। এই জমি মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করা আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ)। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায়ও (আরএসটিপি, ২০২২-৩৫) একই প্রস্তাব করা হয়েছে। আবার নারায়ণগঞ্জ সদর ও বন্দরকে সংযুক্ত করতে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর কদমরসুল সেতু নির্মাণ প্রকল্পে সড়ক প্রশস্ত করতে রেলওয়ের ওই জমির কিছু অংশ অধিগ্রহণ করার কথা।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বিপণিবিতান নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তুলেছে। সেখানে বিপণিবিতান হলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দফায় দফায় চিঠিও দিয়েছে তারা।

জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ওই জমি রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্টকে বিপণিবিতান করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন। বিপণিবিতান নির্মাণের চেষ্টা চলছিল এক যুগ ধরে। ২০১২ সালে বিপণিবিতান নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে স্থানীয় বাসিন্দারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। প্রতিবাদের মুখে তখন বিপণিবিতান নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়। তবে ২০২২ সালের আগস্টে বিপণিবিতান নির্মাণকাজ আবার শুরু হয়। সরেজমিনে ৪ মে দেখা যায়, বিপণিবিতানটির একটি ভবনের ছাদঢালাইয়ের কাজ চলছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বিপণিবিতান নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তুলেছে। সেখানে বিপণিবিতান হলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দফায় দফায় চিঠিও দিয়েছে তারা। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিপণিবিতান নির্মাণ বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমকে চিঠি দেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।

চিঠিতে মেয়র বলেন, ড্যাপ ও কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব নির্মাণের প্রস্তাবিত জমিতে বিপণিবিতান তৈরি ইমারত নির্মাণ বিধিমালার লঙ্ঘন। যেভাবে বিপণিবিতান তৈরি করা হচ্ছে, সেটি অবৈধ।

মেয়রের চিঠির পরও কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি রেলপথ মন্ত্রণালয়। নিউজিল্যান্ডে থাকা মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী গত সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যে জমিতে জনগণের জন্য একটি প্রকল্প হবে, সেখানে কোনোভাবে বিপণিবিতান করতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন।

চিঠি পাননি, দাবি মন্ত্রীর

রেলওয়ের জমিতে যে বিপণিবিতান নির্মাণ করা হচ্ছে, সেটির নাম দেওয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শপিং কমপ্লেক্স-৩। সিটি করপোরেশন নির্মাণকাজ বন্ধে রেলমন্ত্রীকে যেমন চিঠি দিয়েছে, তেমনি চিঠি দেওয়া হয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকেও (রাজউক)।

রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিঠি পাননি। তবে আইন বা বিধিবহির্ভূতভাবে কোনো স্থাপনা হলে এবং সেটি নিয়ে সিটি করপোরেশনের আপত্তি থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রাজউকের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হয় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। এতে বলা হয়, রাজধানীর অতি সন্নিকটে শিল্পঘন ও জনবহুল বন্দর নগর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা। এর আয়তন মাত্র ৭২ দশমিক ৪৩ বর্গকিলোমিটার। এখানে প্রায় ২০ লাখ লোক বসবাস করেন। নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক ও শিল্পনগরী হওয়ায় জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এখানে প্রতিদিন কয়েক লাখ যানবাহন আসা-যাওয়া করে। নারায়ণগঞ্জ নগরীর পরিবহন অবকাঠামো খুবই অপ্রতুল। এ পরিস্থিতিতেও পরিবহন হাব নির্মাণ জরুরি। কিন্তু প্রস্তাবিত পরিবহন হাবের স্থানে বিপণিবিতান গড়ে উঠছে।

রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার আগে চিঠিটি এসেছে। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে কোনো ব্যত্যয় থাকলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

যে জমিতে জনগণের জন্য একটি প্রকল্প হবে, সেখানে কোনোভাবে বিপণিবিতান করতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন।
নিউজিল্যান্ডে থাকা মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী

বেড়া দিয়ে চলছে নির্মাণকাজ

সরেজমিনে ৪ মে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ের জমিটির কাছেই শীতলক্ষ্যা নদী। জমির আশপাশে বেশ কয়েকটি সড়ক। পাশেই রেলস্টেশন। সব মিলিয়ে জমিটি নৌ, সড়ক ও রেলপথের কেন্দ্র করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।

জমিটি পড়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশে কোনো খালি জমি নেই যে সেখানে মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব করা যাবে। এখন বিপণিবিতান নির্মাণ করা হলে মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব করার সুযোগ থাকবে না। এটা নারায়ণগঞ্জের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আপত্তি উপেক্ষা করে জমিটিতে প্রভাবশালীদের স্বার্থে বিপণিবিতান করা হচ্ছে।’

রেলওয়ের জমিটিতে টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে ভেতরে নির্মাণকাজ চলে। গিয়ে দেখা যায়, জমিটির একটি অংশে একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। একাংশে ছাদঢালাই শেষ। বাকি অংশের কাজ চলছে।

নির্মাণাধীন ভবন-সংলগ্ন কক্ষে ছিলেন এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বলে পরিচয় দেন। নাম বলেন রুবেল। তাঁর ভাষ্য, ভবনটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক আকরাম আলী শাহীন, যিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর জাতীয় পার্টির সাবেক আহ্বায়ক।

আকরাম আলীর ভাষ্য, একটি দোকান বরাদ্দের ক্ষতিপূরণ ব্যয় হিসেবে রেলওয়ে ১ লাখ ৪১ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। আর দোকানের নির্মাণ ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানতে চাইলে রুবেল বলেন, নির্মাণাধীন ভবনের দক্ষিণ পাশের ফাঁকা জায়গায় আরও দুটি চারতলা ভবন নির্মাণ করা হবে। সব কটি ভবন মিলিয়ে মোট ৩০০টি দোকান হবে। একেকটি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ২৫-৩০ লাখ টাকায়।

আকরাম আলী শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেকে নারায়ণগঞ্জ শপিং কমপ্লেক্স-৩ ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী, বিপণিবিতানের ৫০ শতাংশ দোকান বরাদ্দ পাবে সমিতি এবং বাকি ৫০ শতাংশ দোকান বরাদ্দ পাবেন রেলওয়ের কর্মচারীরা। এই বিপণিবিতান তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১২ বছর আগে। তখন নারায়ণগঞ্জ হকার্স সমিতির সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। তখন হকার্স সমিতির নামে দোকান বরাদ্দের জন্য টাকা জমা দিয়েছিলেন সদস্যরা। এখন সেই সমিতি আর নেই। তবে আগের সমিতির সদস্যরাই নতুন সমিতির সদস্য। এখন নতুন সমিতির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

আকরাম আলীর ভাষ্য, একটি দোকান বরাদ্দের ক্ষতিপূরণ ব্যয় হিসেবে রেলওয়ে ১ লাখ ৪১ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। আর দোকানের নির্মাণ ব্যয় পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হতে পারে। এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দোকান বরাদ্দের নামে ২৫-৩০ লাখ টাকা করে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তাঁর জানা নেই। ২০১২ সালে বরাদ্দ নিয়ে, সেটি কেউ হস্তান্তর করে থাকতে পারেন। এক ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে দোকান হস্তান্তরিত হলে এটি হতে পারে। সমিতি এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত নয়।

বিপণিবিতান হলে মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব কীভাবে হবে, জানতে চাইলে আকরাম আলী বলেন, মাল্টিমোডাল পরিবহন হাব যখন হবে, তখন দেখা যাবে।

‘কাজটি অনৈতিক’

রাজউকের প্রস্তাবিত মাল্টিমোডাল পরিবহন হাবের জন্য নির্ধারিত জমিতে ব্যক্তিস্বার্থে বিপণিবিতান তৈরি করে নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে বলে মনে করেন ভূমি রক্ষা নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ সালে আন্দোলনের মুখে রেলওয়ে বলেছিল, এখানে বিপণিবিতান হবে না। এখন সরকারি প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করে এখানে বিপণিবিতান হচ্ছে। কাজটি অনৈতিক। তিনি বলেন, এই অনৈতিক কাজে কারা সহযোগিতা করছে, প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না, সেটি খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

রফিউর রাব্বি বলেন, স্থানীয় কতিপয় ভূমিদস্যু ও সরকারি সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারি জমি আত্মসাৎ করা হচ্ছে।