বিদেশে সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের মধ্যেও কমেছে নারী কর্মীর সংখ্যা

প্রতারিত হয়ে গত বছর খালি হাতে ফিরে এসেছেন তিন হাজার নারী কর্মী। 

বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গত দুই বছর নতুন রেকর্ড হয়েছে। তবে এর মধ্যেও কমেছে নারীর কর্মসংস্থান। প্রতি মাসে গড়ে লাখের বেশি কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে। গত বছর (২০২৩) বিদেশে মোট কর্মী গেছেন ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে নারী কর্মী গেছেন ৭৭ হাজার ২৬৩ জন। এ ছাড়া গত বছর প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তিন হাজার নারী কর্মী।

অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানা হয় না। আবার প্রশিক্ষণের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিবছর অনেক নারী দেশে ফিরে নির্যাতন-নিপীড়নসনহ নানা অভিযোগ করছেন। এ কারণে নারী কর্মী পাঠানো কমে গেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বছরের চুক্তিতে সৌদি গেলেও তা শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসছেন কেউ কেউ। অধিকাংশই পালিয়ে এসে সেফ হোমে আশ্রয় নেন। দূতাবাসের সেফ হোম থেকে তাঁদের সৌদি সরকারের সেফ হোমে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, এক বছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন নারী কর্মী বিদেশে যান ২০১৭ সালে। এর আগের বছর এটি ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন। এর আগের বছরেও এক লাখের বেশি ছিল বিদেশে নারীর কর্মসংস্থান। বছরে এক লাখের বেশি কর্মী পাঠানোর এ ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৯ সাল পর্যন্ত। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর এটি কমতে থাকে। পরের দুই বছর আবার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ২০২২ সালে এটি এক লাখ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু গত বছর কমে গেছে।

১৯৯১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয়। নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। নারী কর্মীদের সিংহভাগ যায় সৌদিতে গৃহকর্মী হিসেবে। কর্মী বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থতা, বাড়ির জন্য কাতর হওয়া, কম বেতন কিংবা বিনা বেতনে কাজ করা, খাদ্যাভ্যাস ও ভাষার সমস্যার পাশাপাশি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বাড়তে থাকে ব্যাপক হারে। 

নারী কর্মীদের নিয়ে দেশে একটা নেতিবাচক প্রচার আছে। তাই নতুন কর্মীদের কারও কারও মধ্যে অনাগ্রহ দেখা যায়। আবার চাহিদা দেওয়ার পর দ্রুত কর্মী চায় সৌদির নিয়োগকর্তারা। নানা দীর্ঘসূত্রতার কারণে পাঠানো যাচ্ছে না। তাই তারা অন্য দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে।
রিক্রুটিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব টিপু সুলতান

পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে ২০২০ সালের মার্চে সৌদি আরব যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লুৎফা বেগম। গৃহকর্মী হিসেবে ১ মাস ৫ দিন কাজ করেছেন। নির্যাতনে টিকতে না পারায় তাঁকে পাঠানো হয় দেশটির সেফ হোম বা সরকারি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে প্রায় তিন মাস থাকার পর দেশে ফিরে আসেন তিনি। লুৎফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, পাশাপাশি দুই বাসায় কাজ করতে হতো। সৌদির খাবারও খেতে পারতেন না। এরপরও কাজ করছিলেন কিন্তু বাসার পুরুষ সদস্যদের আচরণ ভালো ছিল না। তাই যাঁর মাধ্যমে গেছেন, তাঁর কাছে অন্য কোথাও কাজ চান। সেটাও পাননি। এরপর দেশে ফিরতে চাইলে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয় তাঁকে। কোনো বেতন পাননি। তবে দেশে ফিরে দুই দফায় ৩০ হাজার টাকার নগদ সহায়তা পেয়েছেন।

সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বছরের চুক্তিতে সৌদি গেলেও তা শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসছেন কেউ কেউ। অধিকাংশই পালিয়ে এসে সেফ হোমে আশ্রয় নেন। দূতাবাসের সেফ হোম থেকে তাঁদের সৌদি সরকারের সেফ হোমে পাঠানো হয়। সৌদি সরকারের অর্থায়নেই দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে সৌদিতে যাওয়ার তিন মাসের মধ্যেই কেউ ফিরে আসতে চাইলে তাঁদের নিয়োগদাতা সৌদি কোম্পানির মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কাজের চাপ, আবহাওয়া, ভাষা ও স্থানীয় খাবারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরেও কেউ কেউ পালিয়ে আসেন।

বিদেশে কর্মী পাঠানোর রিক্রুটিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বায়রা) যুগ্ম মহাসচিব টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, নারী কর্মীদের নিয়ে দেশে একটা নেতিবাচক প্রচার আছে। তাই নতুন কর্মীদের কারও কারও মধ্যে অনাগ্রহ দেখা যায়। আবার চাহিদা দেওয়ার পর দ্রুত কর্মী চায় সৌদির নিয়োগকর্তারা। নানা দীর্ঘসূত্রতার কারণে পাঠানো যাচ্ছে না। তাই তারা অন্য দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে।

দেশের অভিবাসী আইন সংশোধন হলেও নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি তাতে আলাদা করে বলা হয়নি। বিদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি।
বাংলাদেশ অভিবাসী নারী শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরিদা ইয়াসমিন

দেশে ফিরে আসা প্রবাসী নারীদের বিভিন্ন সহায়তা দিতে নিয়মিত কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি। তারা বলছে, সৌদিতে গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে মালিকের হাতে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরার ঘটনা কোনোভাবেই থামছে না। দেশে ফিরে নির্যাতন-নিপীড়নের নানা অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। যৌন নির্যাতনের শিকার কেউ কেউ ফিরছেন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে। কাজের নিরাপদ পরিবেশ না থাকায় সৌদি আরব থেকে প্রায় প্রতি মাসেই নারী গৃহকর্মীরা ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। 

বিদেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের কোনো হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে। তবে যাঁরা পাসপোর্ট হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আউটপাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) নিয়ে ফেরেন, তাঁদের হিসাব রাখে ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক। বিমানবন্দরে কাজ করে এ ডেস্ক। সূত্র বলছে, গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে খালি হাতে দেশে ফিরে এসেছেন ৮৬ হাজার ৬২১ জন কর্মী। এর মধ্যে নারী কর্মী আছেন ২ হাজার ৯০২ জন। সর্বশেষ ডিসেম্বরেও ফিরেছেন ২৪৯ জন নারী।

বাংলাদেশ অভিবাসী নারী শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অভিবাসী আইন সংশোধন হলেও নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি তাতে আলাদা করে বলা হয়নি। বিদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। এখনো নিয়মিত নির্যাতিত হচ্ছেন তাঁরা। ভীতি থেকে নারীরা যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তাই বিদেশে কর্মী পাঠানো বাড়লেও আনুপাতিক হারে নারী কর্মী পাঠানো কমছে।