অভিযান গেলে বাধা, বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করেন না ইটভাটার মালিকেরা

লামার ফাইতং ইউনিয়নের শীবাতলী মারমাপাড়া ও শীবাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন ইটভাটা। সম্প্রতি তোলাছবি: মং হাই সিং মারমা

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান, আদালতের নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনের নির্দেশ—কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছেন না বান্দরবানের অবৈধ ইটভাটার মালিকেরা। কৃষিজমি ও পাহাড় কেটে চালাচ্ছেন ইটভাটা। এতে পরিবেশদূষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে বনভূমির গাছপালা। জেলায় প্রায় অর্ধশত অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম চললেও সেগুলো বন্ধ করতে পারছে না প্রশাসন। অনেক স্থানে প্রশাসন অভিযান চালালেও ফের ভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। আবার শ্রমিক-মালিকদের বাধার মুখে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও ইটভাটায় ঢুকতে পারেননি—এমন ঘটনাও ঘটেছে।

প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী, বান্দরবানের ৭টি উপজেলায় ৭০টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার সবগুলোই অবৈধ। কোনোটিরই নেই পরিবেশের ছাড়পত্র। গত বছর সব কটি ইটভাটা বন্ধ ছিল। তবে বর্তমানে জেলার লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম ও থানচি উপজেলার ৪৩টি ভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে লামা উপজেলায় ৩৬টি, আলীকদমে ২টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৪টি ও থানচিতে ১টি ইটভাটা চালু রয়েছে। রুমা, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় ইটভাটা বন্ধ রয়েছে।

জেলার সবচেয়ে বেশি ৩৬টি ইটভাটা রয়েছে লামা উপজেলায়। এর মধ্যে লামার ফাইতং ইউনিয়নেই রয়েছে ২৬টি ইটভাটা। গত ১৫ ও ১৮ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে বিফল হন। সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের দুই শতাধিক সদস্য সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মালিক-শ্রমিকদের বাধায় ইটভাটায় ঢুকতে পারেননি। পরিবেশ অধিদপ্তরের বান্দরবানের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেছেন, ইটভাটার মালিক-শ্রমিকদের এমন বেপরোয়া মনোভাব তিনি আগে কখনো দেখেননি।

জানতে চাইলে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযান চালিয়ে বহু ইটভাটাকে জরিমানা করা হয়েছে। কিছু ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে ভেঙে দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আবার সেসব ইটভাটা চালু করেন মালিকেরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লামার ৪১টি ইটভাটার মধ্যে কেবল ১৩টিতে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়। ওই সব ইটভাটায় জিগজ্যাগ চুল্লি রয়েছে। অন্যগুলোতে বনাঞ্চল ধ্বংস করে জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। মাটি সংগ্রহ করা হয় পাহাড় ও কৃষিজমি খনন করে। ফাইতংয়ের শিবাতলী এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিবাতলীপাড়া, মে অংপাড়ার তিনটি পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। ইটভাটার চুল্লির ধোঁয়া, তাপে ও যানবাহনের শব্দে পাড়াবাসী নাকাল হচ্ছেন। জনপ্রতিনিধিরা জানান, শিবাতলীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে একটি ইটভাটা রয়েছে। এর কারণে শিক্ষার্থীরা দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে।

শিবাতলীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১১টি ইটভাটা রয়েছে। সেখানে ব্যাপক হারে পাহাড় কাটা ও বন ধ্বংসের কারণে পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। দূষণের কারণে সবচেয়ে সংকটে পড়েছে নারী ও শিশুরা। চালু ইটভাটার মধ্যে চারটিতে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ড্রাম চিমনি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ১২টিতে রয়েছে ইটের তৈরি চিমনি। জিগজ্যাগ ভাটায় জ্বালানি কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য ইটভাটার মতো একই ভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে পাহাড় ও কৃষিজমি কেটে সেখানে ইট তৈরির মাটি সংগ্রহ করা হয়।

লামা ফাইতংয়ের ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মুক্তার আহম্মদ পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ঢুকতে না দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, সরকার বা প্রশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে ইটভাটা চালানো সম্ভব হবে না, সেটা তাঁরাও জানেন। কিন্তু কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং শত শত শ্রমিকের কর্মসংস্থানের বিষয়টি নিয়েও সরকারকে ভাবতে হবে। এ জন্য প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসায় আসতে চান। বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম বলেছেন, শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর দায়িত্ব দিয়ে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা কঠিন। বন বিভাগ যদি কঠোরভাবে জ্বালানি কাঠ বন্ধ করতে পারে, ইটভাটা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবেশ অধিদপ্তরে এখন জনবলসংকট ও অর্থসংকট রয়েছে। তবে অভিযান চলবে। তিনি বলেন, একাধিক দল অভিযান চালালেও ৭০টি ইটভাটা ধ্বংস করতে ১৫ থেকে ২০ দিন লাগতে পারে। এতে ব্যয় হতে পারে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা।

লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন বলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ফাইতংয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দল ঢুকতে না পারায় মালিকেরা বন্ধ থাকা অবৈধ ইটভাটাগুলো চালু করার সাহস পেয়েছেন। মালিকেরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যখনই বলা হবে, প্রশাসন আবার অভিযানে নামতে প্রস্তুত রয়েছে বলে ইউএনও জানান।