সব মানুষকে এগিয়ে নেওয়ার পথ সুগম করাই প্রধান কাজ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।

রোখসানা দিল আফরোজ

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চের সকালে যখন আমার আব্বা ডা. এ কে এম গোলাম মোস্তফা আর আমার মেজ খালু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী আলী ইমাম চট্টগ্রামে পুলিশ লাইনসের সামনে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের গুলিতে শহীদ হন, তখন আমি নেহাতই সাড়ে তিন বছরের শিশু। সে সময়ের সব কথা বড়দের কাছ থেকে শোনা। স্মৃতির পাতা খুললেই মা-খালাদের অস্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখেছি। তাঁদের টুকরো টুকরো স্মৃতির মালা জোড়া দিয়েই আমার ইতিহাসজ্ঞান। আমার খালাতো-মামাতো ভাইবোনেরা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন। তাঁদের প্রভাবেই আমি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠি।

আমার অকালবিধবা মাকে কঠিন জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে দেখেছি। দেখেছি পাড়ার স্বল্পশিক্ষিত বিধবা ও নিম্ন আয়ের মানুষদের তার মধ্যেও বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে। এসব স্মৃতি গড়ে তুলেছে আমার সমাজভাবনা এবং নারীর প্রতি অসীম শ্রদ্ধাবোধ। সবচেয়ে বড় যে আবেগটি আমি অনুভব করি, তা হলো আমাদের একটি সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে। নইলে আমার বাবাসহ সমস্ত শহীদের আত্মদান আর আমার মায়ের জীবনযুদ্ধের কোনো অর্থ থাকবে না।

আমি পেশাগতভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার পাশাপাশি ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ উপপরিষদের সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করছি। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে যাচ্ছি। নানা কিছুর মধ্যে আমরা বীরাঙ্গনাদের সম্মাননা জানাই এবং সরকারের কাছে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি এবং ভাতার ব্যবস্থা করার আহ্বান জানাই। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসকদের সম্মাননা জানানো এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণের ব্যবস্থা করার মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।

আমি মনে করি, সব দায়িত্ব কেবলই সরকারের নয়। কেবলই সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। আমাদের নিজেদের দিক থেকেও উদ্যোগী হতে হবে। সমাজে চেপে বসা অসংগতি দূর করা, পরিবেশ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কাজ করাসহ নানা বিষয়ে দেশে-বিদেশে থাকা বাঙালিদের বহু কিছু করার আছে।

দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি বড় ব্যাধি। শরীরের রোগ নিরাময়ের মতো এই সামাজিক ব্যাধি নিরাময়েও আমাদের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। আমরা প্রত্যেকে যদি নিজের কাজ ও দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পন্ন করি, নিজে দুর্নীতিতে না জড়াই, তা হলেও সমাজে অনেক বড় অগ্রগতি হবে। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি। শহীদের আত্মদান, বীরদের সাহস নিশ্চয়ই আমাদের শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

আরেকটি কথা এখানে বলা দরকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে একটা দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য ও অগ্রগতি হয়েছে। তবে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, উদার ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। এখানে সরকারের একটা বড় দায়িত্ব আছে। আমি মনে করি, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ রাষ্ট্রের চার মূলনীতি যথাযথভাবে সংবিধানে ফিরিয়ে আনা উচিত।

দেশের সব নাগরিকের এগিয়ে যাওয়ার পথ থেকে সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দিতে হবে, যাতে মানুষের মেধা-মনন ও সৃজনশীল সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী এই জাতির সব সদস্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে তোলাই হবে হবে আমাদের প্রধান কাজ। এটুকু করতে পারলে অবশ্যই সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।

ডা. রোখসানা দিল আফরোজ: চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী এ কে এম গোলাম মোস্তফার কন্যা