বিজয়ের পথ—৮
ইন্দো সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধে নতুন মেরুকরণ
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এসেছিল কঠিন পথে; অসংখ্য মানুষের ত্যাগে ও সংগ্রামে, নানা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক উদ্যোগে। গুরুত্বপূর্ণ সেসব ঘটনা নিয়ে এ আয়োজন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাড়ে চার মাসের মাথায় নাটকীয়ভাবে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি হয়। এই চুক্তি মুক্তিযুদ্ধে নতুন শক্তি সঞ্চার করে। মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আসে নতুন মোড়।
চুক্তিটিকে অনেকে আকস্মিক হিসেবে দেখেন। হাসান ফেরদৌস মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৩) বইয়ে অবশ্য লিখেছেন, এ ধরনের একটি চুক্তি নিয়ে দুই বছরের বেশি সময় ধরে আলাপ-আলোচনা চলছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ চুক্তিটিকে ত্বরান্বিত করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তড়িঘড়ি করে চুক্তিটি সইয়ের পেছনে জরুরি তাগিদ হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক আঁতাত। মঈদুল হাসান মূলধারা ’৭১ (ইউপিএল, ২০০৮) বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধানে’ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ব্যাপারে ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশ আশাবাদী ছিল। জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতির পরিবর্তন স্পষ্ট হলে এই আশা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
মার্কিন নীতি পরিবর্তনের কেন্দ্রে ছিল এত দিনকার শত্রু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় জুলাইয়ে পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে পাকিস্তান থেকে পিকিং যান। ওয়াশিংটনে ফিরে তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষ নেয়, নয়াদিল্লিকে তারা সাহায্য করবে না।
ভারত চরম নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে। নিরাপত্তাহীনতা কাটাতে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের শরণাপন্ন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নও তাদের ভারসাম্যের নীতি ঢেলে সাজায়। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের আশঙ্কা বিবেচনা করে ভারত দুই বছরের পুরোনো খসড়া ঝেড়েমুছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়।
৮ আগস্ট সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রেই গ্রোমিকো আকস্মিক সফরে নয়াদিল্লি যান। ৯ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারত-সোভিয়েত ২০ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি হয়। সই করেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকো।
মঈদুল হাসান উল্লেখ করেছেন, এই চুক্তিটির সম্ভাবনা বহির্বিশ্বের কাছে ছিল অভাবনীয়। অন্যদিকে ভারতের ক্ষমতাসীন মহলেও এ ব্যাপারে খুব অল্পসংখ্যক লোকের সামান্যতম ধারণা ছিল।
চুক্তিতে ভারতের জন্য তিনটি ধারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল: ১. দুই দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে যায়, এমন সামরিক আঁতাতে যাবে না। ২. পরস্পরের ভূখণ্ড যাতে তৃতীয় শক্তি ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে দুই দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। ৩. দুই দেশের কেউ ভবিষ্যতে সামরিক সংঘর্ষে জড়ালে তারা তৃতীয় পক্ষকে মদদ জোগাবে না। যেকোনো নিরাপত্তাজনিত হুমকির মুখে দেশ দুটি তা দূর করাসহ শান্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করবে।
মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী, সর্বশেষ বিষয়টি এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘নিরাপত্তা’ ধারা (নবম ধারা)। চুক্তিটি হয়ে উঠেছিল ভারতের জন্য এক নিরাপত্তা রক্ষাকবচ। বইটির তথ্য অনুযায়ী, এই চুক্তি নিয়ে ভারতের সংসদে শরণ সিং বলেছিলেন, ভারতের সংহতি-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাতের চক্রান্তকারী যে কেউ এখন কিছু করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবে। গ্রোমিকোও সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থায় জানান, এমন কোনো দেশ নেই যে ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে কোনো নীতি গ্রহণের সময় চুক্তিটিকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।
হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ার্স (সাইমন অ্যান্ড শুস্টার, ১৯৭৯) বইয়ে এই চুক্তির সংবাদকে ‘বোমা বিস্ফোরণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ভাষায়, চুক্তির ফলে ভারতীয় সমর পরিকল্পনাবিদেরা পুরোমাত্রায় যুদ্ধযাত্রার অনুমতি পেয়ে যান। তবে হাসান ফেরদৌস লিখেছেন, চুক্তিটি যদি কোথাও ‘বোমা ফাটানোর ঘটনা’ হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে সেটি পাকিস্তানে। দেশটির পত্রপত্রিকা ও সামরিক প্রশাসনে এ নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে যায়।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চুক্তিটিকে স্বাগত জানায়। তারা এই ভেবে আশ্বস্ত হয় যে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের আঁতাতে শঙ্কিত ভারত এবার তাদের প্রত্যক্ষ সামরিক সামর্থ্য জোগাতে বেশি আগ্রহী হবে। পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন সরাসরি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে।
চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন ও আশাব্যঞ্জক অধ্যায় শুরু হয় বলে মঈদুল হাসান উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এত দিন মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্যের ক্ষেত্রে পাকিস্তান-চীনের যৌথ প্রতিক্রিয়ার কথা ভারতকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হতো। চুক্তির ফলে এই ঝুঁকি কমে যাওয়ায় ভারতের সহযোগিতা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এত দিন অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে অসুবিধা ছিল, তার দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে আগস্টের শেষ দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সংখ্যাও বাড়ে।
পরিস্থিতি নাজুক দেখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মুহাম্মদ খানকে মস্কো পাঠান। ৬ সেপ্টেম্বর গ্রোমিকোর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। বৈঠকের বিবরণ আছে সুলতানের মেমোরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশনস অব আ পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট (লন্ডন সেন্টার ফর পাকিস্তান স্টাডিজ, ১৯৯৭) নামের স্মৃতিকথায়। চুক্তিটি নিয়ে সুলতান উদ্বেগ জানালে গ্রোমিকো বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরব থাকবে না। উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সে জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথে এগোতে হবে।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মস্কো যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সফরের পর বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় মনোভাবের সঙ্গে সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গি কার্যত অভিন্ন হয়ে আসতে থাকে। চুক্তি অনুযায়ী মতবিনিময়ের জন্য ২২ অক্টোবর নয়াদিল্লি যান সোভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফেরুবিন। অক্টোবরের শেষ দিকে নয়াদিল্লিতে ঝটিকা সফর করেন সোভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পাভেল কুতাকফ। সফরে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে উভয় পক্ষ মতৈক্যে পৌঁছায়। নভেম্বরের গোড়ার দিকে মস্কোতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কে এস সেলভানকার সোভিয়েত যুদ্ধমন্ত্রী মার্শাল গ্রেচকোর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে গ্রেচকো জানান, তাঁর দেশ মৈত্রী চুক্তির শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের এই প্রতিশ্রুতির জোরালো প্রতিফলন দেখা যায় পরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন পর্যন্ত।
তথ্যসূত্র:
১. হাসান ফেরদৌস (২০১৩), মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা, প্রথমা প্রকাশন
২. মঈদুল হাসান (২০০৮), মূলধারা ’৭১, দ্য ইউনিভার্সটি প্রেস লিমিটেড
৩. হেনরি কিসিঞ্জার (১৯৭৯), দ্য হোয়াইট হাউস ইয়ার্স, সাইমন অ্যান্ড শুস্টার
৪. সুলতান মুহাম্মদ খান (১৯৯৭), মেমোরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশনস অব আ পাকিস্তানি ডিপ্লোম্যাট, লন্ডন সেন্টার ফর পাকিস্তান স্টাডিজ