হাইকোর্টের এক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা বিষয়ে তথ্যসংবলিত হলফনামা দাখিল করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হচ্ছে। বৃহত্তর জনস্বার্থ বিবেচনায় প্রার্থীর তথ্যসংবলিত ‘হলফনামা’ দাখিল বিষয়ে আইন বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, জাতীয় সংসদ, জেলা ও উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা দাখিল করতে হয়। আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের শুধু ঘোষণাপত্র দিলেই চলত। রায়ের ফলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শুধু ঘোষণাপত্র নয়, আইন অনুসারে প্রার্থীদের তথ্যসংবলিত হলফনামা দাখিল করতে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এ জন্য আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে ইসিকে বিধিমালা সংশোধন করতে হবে। ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর আট দফা তথ্য দাখিলে প্রয়োজনে ইসি আইন সংশোধনের জন্য উদ্যোগও নিতে পারে।
‘মোহাম্মদ ফারুক উল আজম বনাম বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন’ শিরোনামে এক মামলার রায়ে ওই নির্দেশনা এসেছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বছরের ১৭ নভেম্বর এই রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায়টি ইতিমধ্যে বেরিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেন, প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক তথ্যসংবলিত ‘হলফনামা’ দেওয়ার ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের সঙ্গে ২০১০ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) বিধিমালায় ফাঁকফোকর দেখা যাচ্ছে। বৃহত্তর জনস্বার্থ বিবেচনায় আইনের সঙ্গে বিধিমালার ফাঁকফোকরের বিষয়ে দৃষ্টি দিতে এবং আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ইসিকে নির্দেশ দেওয়া হলো। রায়ের কপি নির্বাচন কমিশনসহ অন্য বিবাদীদের তাৎক্ষণিক পাঠাতেও বলা হলো।
২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থী নির্বাচনের অযোগ্য নন, এ-সংক্রান্ত তথ্য হলফনামা করে জমা দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। অন্যদিকে ২০১০ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) বিধিমালায় (২০১৬ সালে সংশোধিত) প্রার্থী হওয়ার যোগ্য—এ বিষয়ে মনোনয়নপত্রের অংশে ঘোষণার কথা উল্লেখ রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া আইনে আরও কোনো সংস্কার, সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন আছে কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে। এরপর এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
আইন ও বিধিমালা যা বলছে
২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের ২৬ ধারায় পরিষদের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা বিষয়ে বলা আছে। কোনো ব্যক্তি চেয়ারম্যান বা সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার এবং থাকার যোগ্য না হওয়ার বিষয়ে ১৭টি দিক আইনের ২৬(২) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রার্থী দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেন বা হারান, কোনো আদালত তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন ২ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তারিখে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে কোনো ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় অনাদায়ি রাখলে, পরিষদের তহবিল তছরুপের কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া ও কোনো আদালত কর্তৃক ফেরারি আসামি হিসেবে ঘোষিত হওয়া—অযোগ্যতার মধ্যে রয়েছে। ২৬(৩) ধারা বলছে, প্রত্যেক চেয়ারম্যান ও সদস্য পদপ্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এই মর্মে একটি হলফনামা দাখিল করবেন যে উপধারা (২) অনুযায়ী তিনি চেয়ারম্যান বা সদস্য নির্বাচনের অযোগ্য নন।
অন্যদিকে ২০১০ সালের স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) বিধিমালায় (২০১৬ সালে সংশোধিত) দেখা যায়, প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের ফরমের তৃতীয় অংশে ‘মনোনীত প্রার্থী কর্তৃক ঘোষণার’ বিষয়টি রয়েছে। এর ভাষ্য, এতদ্দ্বারা ঘোষণা করা হচ্ছে যে মনোনয়নে সম্মতি দেওয়া হয়েছে এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের ধারা ২৬(১) অনুযায়ী চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনের ২৬(২) ধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বা থাকার জন্য অযোগ্য নন। একাধিক পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়নি ঘোষণার অপর দফায় এটি উল্লেখ রয়েছে।
১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২(৩বি) অনুচ্ছেদ অনুসারে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে আটটি তথ্য ও কোনো কোনো তথ্যের সপক্ষে কাগজপত্র দাখিল করার কথা বলা রয়েছে। আট তথ্যের মধ্যে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা, বর্তমানে কোনো ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত আছেন কি না, ব্যবসা বা পেশার বিবরণ, সম্ভাব্য আয়ের উৎস, প্রার্থীর নিজের ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপিল বিভাগের রায় আছে, নির্বাচনে প্রার্থীকে আট দফা তথ্যসংবলিত হলফনামা দাখিল করতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের আট দফা তথ্য হলফনামা আকারে দাখিল করতে হয়। তবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ আইনে হলফনামা দেওয়ার এবং ইউনিয়ন পরিষদ বিধিমালায় ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আট দফা তথ্য হলফনামা আকারে দাখিল করার বিষয়ে আইন ও বিধিমালায় উল্লেখ নেই। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের আটটি তথ্য দেওয়ার বিষয়টি যেন হলফনামায় থাকে, এটিই হাইকোর্টের অভিপ্রায়।’
মনোনয়নপত্র বাতিল নিয়ে প্রার্থীর রিট ও রায়
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বক্তপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠানের দিন ছিল। তবে ঋণখেলাপির জামিনদার হিসেবে চেয়ারম্যান প্রার্থী ফারুক উল আজমের মনোনয়নপত্র বাতিল করে ইসি, যার বৈধতা নিয়ে তিনি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দিয়ে তাঁকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনুমতি দিতে ইসিকে নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে অপর চেয়ারম্যান প্রার্থী সোলাইমান আপিল বিভাগে আবেদন করেন। আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত চেয়ারম্যান পদে ফলাফল ঘোষণার গেজেট প্রকাশে স্থগিতাদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় বিষয়টি আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। গত বছরের ৬ মার্চ আপিল বিভাগের রুল নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে পাঠান। রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ চলমান থাকবে বলা হয়। রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ১৭ নভেম্বর হাইকোর্ট ফারুক উল আজমের মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে ইউনিয়ন পরিষদটিতে আইন অনুসারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে নির্দেশ দিয়ে ওই রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে আইনজীবী হাসান এম এস আজিম ও মো. জাহেদ উল আনোয়ার শুনানিতে ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
আইনজীবী হাসান এম এস আজিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থী সম্পর্কে ভোটারদের জানার অধিকার আছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্যসংবলিত হলফনামা দাখিল করতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আইনে তথ্যসংবলিত হলফনামা প্রার্থীকে দাখিল করতে হবে বলা আছে। অথচ এত দিন শুধু প্রার্থীদের ঘোষণাপত্র দিয়েই চলত। হাইকোর্টের রায়ের ফলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীদের আইনে উল্লিখিত তথ্যসংবলিত হলফনামা দাখিলে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে এখন স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) বিধিমালা ইসিকে সংশোধন করতে হবে। আর তথ্যসংবলিত হলফনামা দাখিল না করলে বা মিথ্যা তথ্য দিলে মনোনয়নপত্র বাতিল হবে, যা আইনেই আছে।