আদালতের নির্দেশের ৯ বছর পরও বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি
ছবি: প্রথম আলো

সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের ৯ বছর পরও চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে এই বধ্যভূমিতে অন্তত পাঁচ হাজার নিরীহ–নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। বধ্যভূমিটি যাতে সংরক্ষণ করা হয়, সে জন্য আইনি লড়াই করতে হয়েছিল। আইনি লড়াই অনেক আগে শেষ হলেও এখনো অবসান হয়নি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার। যার কারণে অযত্ন–অবহেলায় পড়ে রয়েছে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ‘জল্লাদখানা’খ্যাত এই বধ্যভূমি।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন, মিলি রহমানসহ ৮ বিশিষ্ট নাগরিকের রিট আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের আদেশ দিয়েছিলেন।

‘প্রজন্ম ৭১’ নামের একটি সংগঠনের পাশাপাশি একাত্তরের শহীদ পরিবারগুলো সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি করে আসছে। কিন্তু আদেশ বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

প্রজন্ম ৭১–এর সভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গাজী সালেহউদ্দিন। এই বধ্যভূমি যাতে সংরক্ষণ করা হয়, সে জন্য তিনি দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন। দুই বছর আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর গাজী সালেহউদ্দিনের বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা আলী করিমসহ একই পরিবারের চারজনকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছিল। একই দিন পাঁচ হাজার নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে এখানে জবাই করা হয়েছিল বলে আদালতের শুনানিতে বিভিন্ন সাক্ষীর বক্তব্যে উঠে আসে।

জানতে চাইলে মুনতাসীর মামুন বলেন, আদালত অনেক আগেই নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু কোনো ডিসিই (জেলা প্রশাসক) কাজটা করছেন না। ডিসি আসেন, ডিসি যান, কেউ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন না।

মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, ‘বধ্যভূমিটি নিয়ে আন্দোলন করতে করতে মারা গেলেন অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন। আমিও লড়াই করতে করতে ক্লান্ত।’

জানা গেছে, বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাহাড়তলীতে পৌনে দুই একর ভূমিতে অবস্থিত বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ জন্য ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল।

পরে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে প্রকল্পটি বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে নেয়। তখন জমিটি কিনে নেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি) কতৃর্পক্ষ। তারা সেখানে ভবন নির্মাণ শুরু করে।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ৮ বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট রিটটি নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগ ওই জমিতে বধ্যভূমি রয়েছে কি না, তা জানতে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লার নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছিল। প্রতিবেদন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো ডিসিই এই বধ্যভূমি সংরক্ষণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বধ্যভূমি এলাকায় একটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভটি ধুলায় মলিন হয়ে আছে। ঘাস, আগাছা, ময়লা–আবর্জনায় ভরে গেছে চারপাশ। মূল বধ্যভূমি যেখানে, সেখানে ইউএসটিসির একটি অর্ধনির্মিত ভবন দাঁড়িয়ে আছে।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান বলেন, প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। ডিসি চাইলে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করতে পারেন। বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের পক্ষে সর্বোচ্চ আদালত অনেক আগেই রায় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি সংরক্ষণে অনীহা কাম্য নয়।

২০১৪ সালের মার্চে যখন আপিল বিভাগ থেকে আদেশ আসে, তখন চট্টগ্রামের ডিসি ছিলেন আবদুল মান্নান। আদেশের পরপরই তিনি বদলি হয়ে যান। মান্নানের পর ডিসি হিসেবে আসেন মেজবাহ উদ্দিন। তারপর আরও চারজন ডিসি চট্টগ্রামে এসে দায়িত্ব পালন করে বিদায় নেন। কিন্তু বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ আর এগোয়নি। গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে যোগ দিয়েছেন আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, এটা (বধ্যভূমি) কি সরকারি জায়গা, নাকি কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গায় রয়েছে। যদি জমি অধিগ্রহণের দরকার পড়ে, তাহলে তা করা হবে। আদালতের নির্দেশনা কী ছিল, তা–ও আমাকে দেখতে হবে। শুধু এটা বলতে পারি, আমি বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যাপারে আন্তরিক।’