পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গণহত্যার প্রতিটি অক্ষর পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। ইসলাম প্রতিষ্ঠা নয়, বরং একাত্তরের গণহত্যার নেপথ্যে ছিল পাঞ্জাবিদের জাতিবিদ্বেষ, বড়ত্ব, প্রভুত্ব ও অহংকার। একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে আজ রোববার সকালে এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) উদ্যোগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জেনোসাইড বক্তৃতামালার দ্বিতীয় এই আয়োজনে ‘ধর্মের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের জেনোসাইড’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ হাননান।
প্রবন্ধে মোহাম্মদ হাননান বলেন, জেনোসাইড হচ্ছে ব্যক্তি থেকে শুরু জাতি-ভূখণ্ডের নাম-নিশানা পর্যন্ত ভুলিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা। গণহত্যার চেয়েও এটা ভয়াবহ। কারণ, এটা শিকড় পর্যন্ত উপড়ে ফেলে। পাকিস্তান আমলে বাঙালিরা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে টিক্কা খান বলেছিলেন, তিনি বাঙালির নাম-নিশানা মুছে দিতে চান। তাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা পরিকল্পিতভাবে সেভাবেই সারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছে। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসের বেলায় অঞ্চলের নাম পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের পোষ্য রাজাকার-আলবদররা বাংলায় আক্রমণ চালিয়েছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়; বরং বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষের কারণে। প্রায় সব গণহত্যাই জাতিবিদ্বেষ থেকে এসেছে।
একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ হাননান। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মসজিদের ইমামদের পাকিস্তানিরা কমিউনিস্ট বলত। সাধারণ মুসলমান তো বটেই, বাংলার মসজিদের ইমামদেরও তারা মুসলমান মনে করত না। পাকিস্তানিদের এ মনোভাবের মধ্যে কোনো ধার্মিকতা ছিল না, ছিল জাতিগত আত্ম অহংকার। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের কিছু বাক্য উদ্ধৃত করে হাননান বলেন, ধর্মগ্রন্থগুলোয় জেনোসাইডকে কোনোভাবেই অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে গণহত্যার প্রতিটি অক্ষর দিন দিন পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এর পেছনে ইসলামি প্রেরণা নেই। এই গণহত্যার নেপথ্যে ছিল পাঞ্জাবিদের জাতিবিদ্বেষ, বড়ত্ব, প্রভুত্ব ও অহংকার।
পরে আলোচনাপর্বে অংশ নিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের গণহত্যার সঙ্গে বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান গণহত্যার তুলনা করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
সিজিএসের পরিচালক শেখ হাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মিলন কান্তি দত্ত, জাতীয় চার্চ পরিষদ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রেভারেন্ড ডেভিড অনিরুদ্ধ দাশ এবং বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়। কোনো ধর্মই গণহত্যাকে সমর্থন করে না বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।