উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী কমেছে আড়াই লাখ

করোনাসহ কয়েকটি কারণে শিক্ষার্থী কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিক্ষাকে জীবনমুখী করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

  • ২০২১ সালে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কমে দাঁড়ায় ৪৪ লাখ ৪২ হাজারে। আগের বছর যা ছিল ৪৬ লাখ ৯১ হাজার

  • ছাত্র কমেছে ২ লাখ ৭৮ হাজার। তবে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ২৯ হাজার

করোনাকালে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমেছে। এক বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় আড়াই লাখ। তবে কমেছে মূলত ছাত্রের সংখ্যা, বিপরীতে অল্প সংখ্যায় বেড়েছে ছাত্রী।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া ২০২১ সালের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

২০২০ ও ২০২১ সাল—এ দুই বছর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও করোনার বিস্তার ছিল। দেশে করোনাকালে যেসব খাতের ওপর বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, সেগুলোর অন্যতম শিক্ষা। ২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পরের দেড় বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সশরীর ক্লাস বন্ধ ছিল।

দেখা যাচ্ছে, যাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই আর ফেরেননি। এর অন্যতম কারণ হলো তাঁরা মনে করেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে যে কর্মে নিয়োজিত হয়েছে, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষাকে জীবনমুখী করা জরুরি, যাতে যেকোনো সময়ে, যেকোনো পর্যায়ে শিক্ষাকে কর্মের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো যায়।
এম তারিক আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টটিউটের অধ্যাপক

বর্তমানে দেশে ৫৩টি (২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী ছিল ৪৪ লাখ ৪১ হাজার ৭১৭ জন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৭৬।

অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থী কমেছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৫৯ জন। এর মধ্যে বেশি কমেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ) শিক্ষার্থী—এ সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। বাকি শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। কমে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২ লাখ ৭৮ হাজার ১১২ জন ছাত্র। তবে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৯ হাজার।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের প্রধান সম্পাদক ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, করোনাসহ আরও কিছু কারণে মোট শিক্ষার্থী কমে থাকতে পারে বলে তাঁরা মনে করছেন। তবে সামনে শিক্ষার্থী বাড়বে বলে ধারণা করছেন। কারণ, এসএসসি, এইচএসসিসহ সমমানের পরীক্ষায় বেশি শিক্ষার্থী পাস করছে।

গবেষণায় পিছিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

নতুন চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাকি সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলেও কমবেশি গবেষণা খাতে খরচ করছে। এর মধ্যে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় (৮ কোটি) করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫১৭। অন্যদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রকাশনাও হয়নি। প্রকাশনায় পিছিয়ে আছে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোতে প্রকাশনার সংখ্যা এক থেকে সাতের মধ্যে।

অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্তত ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়নি। বিপরীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ পরিচিত কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ও প্রকাশনা তুলনামূলক বেশি ছিল।

শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ে বিস্তর ব্যবধান

ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২১ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সরকার শিক্ষার্থীপিছু সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে তুলনামূলক নতুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ওই বছরে খরচ হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজারের বেশি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় (৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা) করা হয় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ইউজিসি বলছে, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের বছরের তুলনায় কমেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয়ে যে বিস্তর ব্যবধান আগে থেকেই ছিল, তা রয়ে গেছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় যেখানে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার বেশি, সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় মাত্র ৭৪৩ টাকা।

শিক্ষাকে জীবনমুখী করা জরুরি

এর আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২১ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) দেখা গিয়েছিল, করোনাকালে এক বছরের ব্যবধানে প্রাথমিকে  (প্রাক্-প্রাথমিকসহ) সাড়ে ১৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৬২ হাজার। এখন ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এল।

উচ্চশিক্ষায় দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইউজিসি বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল নিয়োগের উদ্দেশ্যে একটি ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস স্থাপনের জন্য ভূমির পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে নীতিমালা প্রণয়ন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জরুরি ভিত্তিতে ‘একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান’ করা, জাতীয় র‍্যাঙ্কিং করাসহ ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, দেখা যাচ্ছে, যাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশই আর ফেরেননি। এর অন্যতম কারণ হলো তাঁরা মনে করেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে যে কর্মে নিয়োজিত হয়েছে, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষাকে জীবনমুখী করা জরুরি, যাতে যেকোনো সময়ে, যেকোনো পর্যায়ে শিক্ষাকে কর্মের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো যায়।