জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর
বিতাড়িত ছাত্রলীগ, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়টা ছিল ঘটনাবহুল। সেসব দিন ফিরে দেখার আয়োজন। আজ ১৭ জুলাই।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় তৎকালীন সরকার এবং সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ) বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ১৭ জুলাই। এর আগে ১৬ জুলাই রাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৭ জুলাই।
সেদিন দুপুর নাগাদ ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের নিয়ন্ত্রণ নেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের কক্ষও ভাঙচুর করেন।
১৬ জুলাই যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, ১৭ জুলাই তাঁদের গায়েবানা জানাজা ও কফিনমিছিলের কর্মসূচি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। এটি হওয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে। নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগেই আখতার হোসেনসহ (এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব) কয়েকজন শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যের সামনে যান। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আখতার হোসেনসহ আন্দোলনরত কয়েকজন শিক্ষার্থীর কথা-কাটাকাটি হয়। পুলিশ আখতার হোসেনকে আটক করে। তখন সেখানে থাকা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান। কিন্তু পুলিশ সংবাদমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্য করে দুটি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে।
পুলিশি বাধায় রাজু ভাস্কর্যের পরিবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা করেন শিক্ষার্থীরা। জানাজা শেষে বিকেল সোয়া চারটার দিকে ক্যাম্পাসে কফিন নিয়ে মিছিল বের করা হয়। ওই মিছিলে একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। উপাচার্যের বাসভবনের সামনের সড়ক ও মলচত্বর এলাকায় দুই ঘণ্টার বেশি সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়।
সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট জরুরি সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে সব আবাসিক শিক্ষার্থীকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ক্যাম্পাসে পুলিশি অভিযান চালানো হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
অন্যদিকে রাতে (১৭ জুলাই) মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। অবশ্য এর আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা)। তিনি লেখেন, ‘পুলিশ, বিজিবি, সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা ও কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ১৮ জুলাই সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে গত মার্চে বেরিয়েছে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের লেখা বই জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু। এই বইয়ে সেদিনের (১৭ জুলাই) ঘটনার বিবরণ রয়েছে।
আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, ক্যাম্পাস বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য হলপাড়ায় যখন আক্রমণ ও গুলি চলছিল, তখন রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাঁরা আলোচনায় বসতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে একপর্যায়ে শর্তসাপেক্ষে আলোচনায় বসতে রাজি হন। এরপর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবু বাকের মজুমদার এবং তিনি মুহসীন হলের সামনে নিজেদের মধ্যে (১৭ জুলাই) কথা বলছিলেন। সেখানে পরে সমন্বয়ক আবদুল কাদেরও আসেন।
সেদিন গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার কৌশলের বিষয়টিও আসিফ মাহমুদ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নাহিদ ভাই আমাকে বললেন, তোমার আলোচনায় আসার দরকার নেই। তুমি বাসায় চলে যাও। আলোচনা চলাকালেই তুমি কর্মসূচি ঘোষণা করে দিও।’