যে জমিতে ঘাস জন্মায় না, সেখানে আমি সোনা ফলাই

অদম্য সাহস আর স্বপ্ন নিয়ে সব সমস্যা মোকাবিলা করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন মো. আল আমিন শিকদারছবি: কিন্নর মাহমুদ
দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব পটুয়াখালীর কুয়াকাটার বাসিন্দা মো. আল আমিন শিকদারের জীবন-গল্প।

সাগরপাড়ের মানুষ আমি মো. আল আমিন শিকদার। পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় সাগরতীরে বাড়ি আমার। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তবে সাগরের কাছে জমিতে নোনা পানির প্রভাব এতটাই বেশি যে, কৃষিকাজে কখনো লাভের মুখ দেখা যেত না। শুধু বর্ষা মৌসুমে ধান চাষের সুযোগ পেতাম। বছর শেষে যে ফসল পেতাম তাতে খরচ উঠত না। অন্যান্য মৌসুমি ফসল যে চাষ করব, সেটিও সাহসে কুলাতো না। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে অন্যান্য ফসলও এখানে ঠিকমতো জন্মায় না।  

বছরের পর বছর এ রকমই চলছে—এই দুরবস্থা শুধু আমার একার না। সাগরপাড়ের সব কৃষকই কমবেশি এ সমস্যা মোকাবিলা করছে। ফলে আমার উপার্জন দিন দিন কমে যাওয়ায় হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম। একদিন গ্রামের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে জানতে পারলাম, আলীপুরে ব্র্যাকের একটা অফিস আছে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সময়োপযোগী ফসলের চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এটা শোনার পর আমার মনে আশার সঞ্চার হলো। আমরা কয়েকজন মিলে যোগাযোগ করলাম।

তারপর একদিন ব্র্যাকের কয়েকজন ভাই আমাদের গ্রামে আসলেন। সব সমস্যা শুনে আমাদের অভয় দিলেন। বললেন, লবণাক্ত জমির কারণে এই এলাকায় চাষাবাদের পদ্ধতি বদলাতে হবে। নতুন ফসল চাষ করলে লাভবান হওয়া যাবে। তারা পরামর্শ দিলেন জমিতে সূর্যমুখী ফুল আর ভুট্টা চাষের, পাশাপাশি চাষের নিয়মও দেখালেন। তাদের থেকেই জানলাম—সূর্যমুখী ফুল থেকে বীজ হয়, সেটি মণ হিসাবে বিক্রি হয়। আর বীজ থেকে তেল হয়। ভুট্টা থেকে হাঁস-মুরগি আর গরুর খাবার হয়। এগুলোর চাহিদা সারা বছরই থাকে। তাদের এসব কথায় সাহস পেলাম।

ব্র্যাক থেকে আমাদের চাষপদ্ধতি শেখানোর পাশাপাশি সারও দেওয়া হয়, এমনকি জমিতে পানি দেওয়ার জন্য সেচযন্ত্রও দেওয়া হয়। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটু দ্বিধা কাজ করল, আসলেই কি এই চাষপদ্ধতি কাজে লাগবে? পরিশ্রম কি বৃথা যাবে? কিন্তু চেষ্টা না করলে তো ফলাফল জানা যাবে না। আল্লাহর ভরসায় জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু করলাম। কিছুদিন বাদে সূর্যমুখী গাছের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার হতাশাও কমতে থাকল। পুরো জমি সূর্যমুখী ফুলে ভরে গেল। অনেক বছর বাদে আমি আশার আলো দেখলাম। প্রথম ফলনে বেশ কয়েক মণ বীজ পেলাম।

কিন্তু কিছুদিন বাদেই নতুন সমস্যার মুখোমুখি হলাম। বীজ থেকে তেল বের করতে হবে। এতে লাভ বেশি। কিন্তু তেল ভাঙাতে যেতে হয় বাজারে। সে তো অনেক দূর। যাওয়া-আসা মিলিয়ে অনেক অসুবিধা। বাধ্য হয়ে আবার ব্র্যাক অফিসের সাহায্য চাইলাম। বললাম, আমাকে যদি একটা তেল ভাঙানোর মেশিনের ব্যবস্থা করেন, তাহলে আমার সঙ্গে গ্রামের অনেক কৃষকেরও উপকার হবে।

মো. আল আমিন শিকদারের নানা চড়াই-উতরাই পেরোনোর এ যাত্রায় পাশে ছিল তাঁর স্ত্রী। আর তাঁদের পাশে ছিল ব্র্যাক
ছবি: কিন্নর মাহমুদ

আমার সব কথা বিবেচনা করে ব্র্যাক থেকে আমাকে মেশিন দেওয়া হয়। এই মেশিনই আমার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। মেশিন বসানোর সঙ্গে সঙ্গে সারা গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সবাই আমার এখানে তেল ভাঙাতে আসে। আমিও তেল ভাঙানোর পর কিছু নিজে ব্যবহার করি, বাকিটা বাজারে বিক্রি করি। এক বছরেই মেশিনের মূলধন ৫০ হাজার টাকা উঠে যায়। পাশাপাশি একই মোটর দিয়ে চাল গুঁড়ো করার মেশিন বসাই এবং চাষাবাদও চালিয়ে যেতে থাকি। এতে আমার আয়ও বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে আমার স্বপ্ন বাড়তে থাকে। এভাবে এক বছর চলে যায়।

শুরুতে চাল গুঁড়ো করার মেশিন কিনতেই সব পুঁজি শেষ হয়ে যায়। তাই কোনো রকমে একটা বেড়ার ঘরে মেশিনটা বসাই। মানুষের অপেক্ষা করতে হয়। বসতে অসুবিধা হয়। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার জমির সামনের অংশে, রাস্তার ধারে নতুন ঘর তুলব। সেখানে মেশিন বসাব। তাহলে মানুষজনের চোখে পড়বে। আসতে আর বসতেও তাদের সুবিধা হবে। প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে নতুন ঘর তুললাম। এর পর আমার চাহিদা আরও বেড়ে গেল। মানুষ সহজেই ভ্যানে করে মালামাল আনতে পারে।

আমি আগের মেশিনের সঙ্গে ভুট্টা ভাঙানোর মেশিন বসালাম। তারপর থেকে আমার কাস্টমাররা ফসল ঘরে তোলার আগেই আমাকে আগাম বুকিং করে। সূর্যমুখী বীজ, ভুট্টা আর চাল গুঁড়ো করে আমার জীবনে সচ্ছলতা ফিরে আসে। আমি কখনো সাহস হারাইনি। ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাই। যার ফলাফল আমি পেয়েছি, এখন আমার আয় বহুমুখী। নিজে সূর্যমুখী আর ভুট্টার চাষ করি। মেশিন থেকেও আয় করি। এখন পরিবারের শখ-চাহিদা পূরণ করতে পারি, যা আগে কখনো পারতাম না।

তবে এত দূর আসার পেছনে আমার স্ত্রীর কৃতিত্ব রয়েছে। সে সব সময় আমার পাশে ছিল। আমার যখন আয় বাড়তে থাকে, তখন স্ত্রীর পরামর্শে সঞ্চয় শুরু করি। কারণ অভাবের পর মানুষের হাতে টাকা এলে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। তাই আমরা দুজনেই হিসাব করে চলি। আমার স্ত্রী তেল ভাঙানোর এবং চাল গুঁড়ো করার মেশিন চালানোও শিখে নেয়। আমি যখন অন্যান্য কাজে বাইরে থাকি, তখন কাউকে বীজ বা ভুট্টা ভাঙাতে আসলে ফেরত যেতে হয় না। আমার স্ত্রীও এখন আমার মতো স্বাবলম্বী। এখন আমার স্বপ্ন নতুনভাবে হলুদ ও মরিচ গুঁড়া করার এবং ধান ভাঙানোর মেশিন বসাব। ভবিষ্যতে একটা গরুর খামার করারও পরিকল্পনা আছে।

অভাবের কারণে এক সময় আমি চিন্তা করতে পারতাম না দিন কীভাবে কাটাব। এখন আমার কাছে গ্রামের মানুষ এসে পরামর্শ নেয়—কীভাবে তাঁরাও আমার মতো স্বপ্ন দেখবে! তবে, মূল কথা হলো—অভাব মানুষকে বড় হতে দেয় না। আমি উচ্ছ্বসিত, কারণ আমি অভাবকে পরাজিত করতে পেরেছি। যে জমিতে আগে ঘাসও জন্মাত না, এখন সেখানে আমি সোনা ফলাই।

(অনুলিখন)