অতিরিক্ত গ্যাস তুলতে গিয়ে বিপর্যয়

গ্যাস না পেয়ে দুই দিনে তিতাসে অভিযোগ করেছেন দুই হাজার গ্রাহক। আরও কয়েক দিন থাকতে পারে গ্যাস-সংকট।

গ্যাস-সংকটে বাসায় ইফতার বা সাহ্‌রির খাবার রান্নার সুযোগ পাচ্ছে না অনেক মানুষ। উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্পকারখানায়। ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও। গ্যাসের এ সংকট আরও কয়েক দিন থাকতে পারে। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন করতে গিয়ে এমন বিপর্যয় তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস উৎপাদনক্ষেত্র মৌলভীবাজারের বিবিয়ানা। দিনে এখানে উৎপাদনক্ষমতা ১২০ কোটি ঘনফুট। গত শনিবারও এখান থেকে তোলা হয় ১২৭ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট গ্যাস। ওই দিন মধ্যরাতের পর গ্যাস প্রক্রিয়াকরণের দুটি ইউনিটে বালু উঠে আসে। বালুর উৎস শনাক্ত করতে না পারায় রোববার ছয়টি কূপের উৎপাদন বন্ধ করা হয়। এতে ৪২ কোটি ঘনফুট উৎপাদন কমায় গ্যাসের সরবরাহ–সংকট দেখা দেয় বিদ্যুৎ, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে।

আরও পড়ুন

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাতে বালু আসতে শুরু করায় বিবিয়ানার ছয়টি কূপ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করতে হয়েছে। উৎপাদনে ফেরার চেষ্টা করছে শেভরন। পেট্রোবাংলার একটি বিশেষজ্ঞ দলও সেখানে কাজ করছে। হঠাৎ করেই ঘাটতিটা বেড়ে গেছে। সব খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে পরিস্থিতি সামলানো হচ্ছে।

কারিগরি ত্রুটির কারণে ছয়টি কূপ বন্ধ করায় গ্যাসের উৎপাদন কিছুটা কমেছে বিবিয়ানায়। নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সহনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে বাংলাদেশ সরকার এবং পেট্রোবাংলার সঙ্গে কাজ করছে শেভরন।
শেখ জাহিদুর রহমান, সংস্থাটির মুখপাত্র

বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদনের দায়িত্বে আছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। বিবিয়ানা থেকে উৎপাদন শুরু হয় ২০০৭ সালে। সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন নিয়ে বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগে অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে মাত্র ১১ বছরের মাথায় ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় সমুদ্রের একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাঙ্গু। এর দায়িত্বে ছিল অস্ট্রেলীয় কোম্পানি সান্তোস। এ ঘটনার পরও বিবিয়ানার ক্ষেত্রে সতর্ক হয়নি পেট্রোবাংলা।

বিবিয়ানায় জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রতিটি কূপের উৎপাদনক্ষমতা দিনে ৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস। ছয়টির মধ্যে রোববার রাতে একটি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতের মধ্যে আরও দুটি কূপ উৎপাদনে আসতে পারে বলে আশা করছে পেট্রোবাংলা ও শেভরন। সংস্থা দুটি বলছে, আজ মঙ্গলবারের মধ্যে আরও দুটি কূপ উৎপাদনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর বালু উঠে আসা কূপটি আবার উৎপাদনে ফেরানোর বিষয়টি অনিশ্চিত।

আরও পড়ুন

তবে অতিরিক্ত উৎপাদনের বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি শেভরন বাংলাদেশ। সংস্থাটির মুখপাত্র শেখ জাহিদুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে ছয়টি কূপ বন্ধ করায় গ্যাসের উৎপাদন কিছুটা কমেছে বিবিয়ানায়। নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও সহনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে বাংলাদেশ সরকার এবং পেট্রোবাংলার সঙ্গে কাজ করছে শেভরন। হঠাৎ করে জরুরি উৎপাদন বন্ধের কারণ অনুসন্ধান করবে সংস্থাটি।

অবশ্য, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছয়টি কূপ বন্ধ করা হয়েছে বলে গত রোববার জানিয়েছিল শেভরন।

গ্রাহকদের ভোগান্তি

গ্যাস–সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার গ্রাহকেরা। এ এলাকায় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস বলছে, দুই দিন ধরে ব্যস্ত সময় পার করছে তিতাসের অভিযোগকেন্দ্র। গ্যাস না পেয়ে গত দুই দিনে দুই হাজারের বেশি গ্রাহক ফোন করেছেন এখানে। কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না তারা। তিতাসের সঞ্চালন লাইনে দিনে প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। বিদ্যুৎ, শিল্প, সার কারখানায় সরবরাহ কিছুটা কমানো হয়েছে। পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বাসার চুলায় গ্যাস পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।

মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, ডেমরা, নারিন্দা, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, পুরান ঢাকার গ্রাহকেরা তিতাসে বেশি অভিযোগ করেছেন বলে জানিয়েছে তিতাস।

খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা নীলু মমতাজ প্রথম আলোকে জানান, দুই দিন ধরে বাসায় গ্যাস নেই। ইফতার ও সাহ্‌রির খাবারের জন্য দোকানে ছুটতে হচ্ছে। দোকানিরা ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

যথাযথভাবে উৎপাদন করা হলে কূপ থেকে বালু আসার কথা নয়। সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন কারণে এটি হতে পারে। বিবিয়ানায় অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন নিয়ে বিভিন্ন সময় সতর্ক করা হয়েছিল।
বদরুল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ

বছরে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের চাহিদা থাকে এ সময়, গ্রীষ্ম মৌসুমে। একই সময়ে রোজা হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশনাও দিয়েছিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এখন উল্টো কমে যাওয়ায় উৎপাদন করতে হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি। ব্যয়বহুল তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

দেশে দিনে ৩৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও গত শনিবার সরবরাহ করা হয় প্রায় ২৯১ কোটি ঘনফুট। গতকাল সরবরাহ করা হয় ২৫২ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ শিল্পকারখানায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা বলছে, ৭ এপ্রিল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) কার্গো দেশে আসার পর সরবরাহ বাড়তে পারে। আর বন্ধ কূপ দ্রুত উৎপাদনে ফেরাতে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল বিবিয়ানায় কাজ তদারকি করছে।

ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথভাবে উৎপাদন করা হলে কূপ থেকে বালু আসার কথা নয়। সক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন কারণে এটি হতে পারে। বিবিয়ানায় অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন নিয়ে বিভিন্ন সময় সতর্ক করা হয়েছিল। এর আগে অতিরিক্ত উৎপাদন করতে গিয়ে বালু ওঠার কারণে বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রের একটু কূপ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।