অদম্য আধুনিকতাবাদী

মাজহারুল ইসলাম

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম প্রয়াত হয়েছেন ১০ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আজও অদম্য হয়ে আছে। আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) এবং পাবলিক লাইব্রেরি (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) মাজহারুল ইসলামের সেই সময়ের দুটি বিস্ময়কর প্রকল্প। এই দুটি কীর্তির মাধ্যমে তিনি পথপ্রদর্শক হয়ে বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সারা জীবন তিনি অবিচল ছিলেন স্থাপত্যের সর্বোচ্চ মান এবং এর নীতি বজায় রাখতে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার যে সেই দুটি অনবদ্য স্থাপত্য তৈরির সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর!

মাজহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৩ সালে। গত হন ২০১২ সালের ১২ জুলাই। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর ডিজাইন করা প্রথম ভবন আর্ট কলেজে। এই ভবনের মাধ্যমেই তাঁর অনবদ্য যাত্রা শুরু হয়। এই যাত্রায় তিনি সেতুবন্ধ করেন স্থাপত্যশিল্পের সঙ্গে জাতি গঠনের, স্থানের চেতনার সঙ্গে আধুনিকতার। তাঁর পরিচিতরা বলেন যে মাজহারুল ইসলামের মৃত্যুর সঙ্গে একটি যুগের সমাপ্তি ঘটেছে। সম্ভবত ১৯৫০-এর দশকে মাজহারুল ইসলামের হাত ধরেই বাংলাদেশে আধুনিক স্থাপত্য সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে। আজ বাংলাদেশি স্থপতিদের কাজ বিশ্বমানে পৌঁছেছে। মাজহারুল ইসলামে এই অভিযাত্রার সংক্ষিপ্তসার মিলবে। তাঁর জীবন এবং কাজ আধুনিকায়ন, পশ্চিমায়ন, ঐতিহ্য আর জাতি গঠনের মধ্যে এক বোঝাপড়া। তাই তাঁর জীবন আর কর্ম দীর্ঘকাল ধরে সমসাময়িক গতিশীলতার মানদণ্ড হিসেবে রয়ে গেছে।

পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য সংস্কৃতির পরিধি এবং রূপকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর এই প্রয়াস ছিল একটি বিশাল কাজের অংশ। সেই কাজ ছিল স্থাপত্যের জন্য একটি আধুনিক অথচ বঙ্গীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করা। তাঁর কাছে আধুনিকতা নিছক স্থাপত্যভাষা বা নান্দনিক ব্যাপার নয়। দেশে তিনি যে সামাজিক বৈষম্য লক্ষ করেছেন, এ ছিল সেই বৈষম্য মোকাবিলার একটি নৈতিক ও যুক্তিসংগত পদ্ধতি। নিজের মার্ক্সীয় নীতিগুলো মিলিয়েছিলেন একটি রাবীন্দ্রিক নীতির সঙ্গে। এই দুই মিলিয়ে নিজের জন্য গড়ে তুলেছিলেন এক চ্যালেঞ্জিং মিশন। আধুনিকতাবাদী আদর্শের প্রতি তাঁর অবিচল প্রতিশ্রুতি সমাজ পরিবর্তনের জন্য একটি আশাবাদী িচন্তা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে এমনকি ইউটোপিয়ানও বলা যায়। এর ফলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী িডজাইন–সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর প্রতিশ্রুতি সমাজের রাজনৈতিক ও নৈতিক মাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং সমান্তরাল ছিল। এই সমাজে স্থাপত্য যতটা না সামাজিক পরিবর্তন বা বৃহত্তর মঙ্গলের উপকরণ, তার চেয়ে বেশি বাণিজ্যিক বা নিছক িচত্রোপম কাজ। এমন একটি সমাজে মাজহারুল ইসলামের কাজ করা সহজ ছিল না।

মাজহারুল ইসলাম চেয়েছিলেন একটি প্রাণবন্ত স্থাপত্যসংস্কৃতি তৈরি করতে। তাঁর এই প্রয়াস নির্ভর করছিল একটি নতুন জাতির (পাকিস্তান, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ) স্থাপত্য পেশা প্রতিষ্ঠার ওপর। সেখানে এসেছিল আমলাতান্ত্রিক ও প্রকৌশল বৃত্তের প্রবল বিরোধিতা। এমনকি কিছু শিক্ষাবিদও তাঁর এই সৃজনশীল বিকল্পের বিরুদ্ধাচরণ করে। লুই কান, পল রুডলফ ও স্ট্যানলি টাইগারম্যানের মতো বিশ্বখ্যাত স্থপতিদের এখানে অনুকরণীয় কাজ তৈরি করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক সংলাপ চালু করার চেষ্টা করেছিলেন।

একজন শিক্ষক, অগ্রণী ও দূরদর্শী হিসেবে মাজহারুল ইসলাম অনেক স্থাপত্যকর্মের বিকাশকে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁর অফিস বাস্তুকলাবিদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তরুণ স্থপতিদের আবেগময় আন্দোলনের সূতিকাগার। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা চেতনা আর্কিটেকচারাল রিসার্চ সোসাইটি। সংগঠনটি এই অঞ্চলের স্থাপত্য ইতিহাসের ওপর যুগান্তকারী গবেষণা চালিয়েছে।

মাজহারুল ইসলাম ছিলেন একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক লক্ষ্যের প্রতীক। সেই লক্ষ্য প্রথা ও আধুনিকতার পুরোনো দ্বৈততার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। ‘আমরা কীভাবে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করব’—বহুবার বলা তাঁর এই কথায় আধুনিকতার প্রতি তাঁর একটি অবাধ ও আদর্শবাদী অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। এ ছিল সদ্য এক ঔপনিবেশিক অতীত থেকে দূরে সরে আসা, যাতে এক নতুন সম্ভাবনাময় অবস্থায় ফিরে আসা যায়। সেই অবস্থা হবে বর্জনীয় ধর্মন্ধতা, ঐতিহ্যের নেতিবাচক দিক আর ভণ্ড আইকনোগ্রাফি থেকে মুক্ত। তিনি ছিলেন বাঙালি রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতি সমর্পিত। তাই তিনি ঐতিহ্যের সহজ মোটিফগুলো গ্রহণ করে এর স্থাপত্যকরণের পক্ষপাতী ছিলেন না।

এ ব্যাপারে মাজহারুল ইসলাম ছিলেন সংলাপের পক্ষপাতী। এই সংলাপের স্থান ছিল বাংলাদেশ। তাই বলে তিনি এই নতুন অবস্থান নিয়ে একটি ‘বিশ্বসংলাপ’–এ জড়িত হতে পিছপা ছিলেন না। ‘সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্ম একে অপরকে স্পর্শ করে’—এ কথা মানতে তাঁর আপত্তি ছিল না। মাজহারুল ইসলাম একটি সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব এবং ‘বিশ্ব-আমার-গ্রাম’—এই মানবতাবাদী ধারণার মধ্যে কাজ করতে চেয়েছিলেন। প্রথম প্রকল্পের সময় থেকেই এই দ্বৈত বাধ্যবাধকতা তাঁর কাজের গতিপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল।

১৯৫০ ও ৬০–এর দশকে মাজহারুল ইসলাম যখন পেশাগতভাবে সক্রিয় ছিলেন, পাকিস্তান তখন রাজনৈতিকভাবে অস্থির। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রভাবশালী রাজনৈতিক চেতনা জেগে উঠেছিল ঘটমান কয়েকটি বিষয় নিয়ে। সেগুলো হচ্ছে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য, কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা ধর্মের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার ইত্যাদি। এর মধ্য দিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার দিকে মেরুকরণ ঘটেছিল। মাজহারুল ইসলাম ছিলেন ওই অংশের সামনের সারির একজন। যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি ছিল তাঁর অবিচ্ছিন্ন অঙ্গীকার। রাষ্ট্র তখন অতিরাজনীতিকৃত ধর্মীয় পরিস্থিতির মধ্যে স্থাপত্য ও সংস্কৃতিকে নিজের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। মাজহারুল ইসলাম তাঁর দার্শনিক অবস্থানের কারণে এর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করতেন। তাঁর কাজ একচেটিয়া প্রতীকীকরণ থেকে দূরত্ব বজায় রাখত। একজন তপস্বীর মতো তিনি সব রকম বাহুল্য বর্জন করতেন। তাঁর কাজে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা। এসবের ফলে তাঁর কিছু কাজকে আপসহীন এবং কঠোর বলে অনেক সময় ভুলভাবে বিবেচিত হয়েছে।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যের ভান্ডার বিস্তৃত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় আকারের আবাসন, সরকারি ভবন, প্রতিষ্ঠান এবং অসংখ্য বাসস্থান ডিজাইন ও নির্মাণ করেন। এর মধ্যে আছে চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মূল মাস্টারপ্ল্যান এবং বিভিন্ন ভবনের নকশা।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ায় আন্তর্জাতিক আধুনিকতাবাদ স্থাপত্যবিদ্যায় কীভাবে সাড়া দিতে পারে মাজহারুল ইসলামের কাজ সে ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান রেখেছে। গরম-আর্দ্র বদ্বীপ অঞ্চলে তিনি বিশেষ েখালােমলা ভবনের নকশা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট কলেজ ও নিপা বিল্ডিং এর দৃষ্টান্ত।

৬০ বছর বয়সী আর্ট কলেজটি এখনো প্রকৃতির সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ঘনিষ্ঠতার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত। পুরোনো দৃশ্যপটের সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কার করে একে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। ১৯৭০–এর দশকের পর থেকে তাঁর কাজগুলো আরও ভারী ধরনের। ভাষা অনেক মাটিঘেঁষা। ১৯৮০ সালে তৈরি ঢাকার জাতীয় গ্রন্থাগার এমন দৃষ্টান্তের অন্যতম। তবুও এই ভবনগুলো উষ্ণ-আর্দ্র বদ্বীপে আলো, সবুজ এবং বাতাসের আধার হওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।

স্বতন্ত্র বাড়িঘর িনর্মাণের বাইরে মাজহারুল ইসলাম সব সময় বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য সঠিক আঞ্চলিক পরিকল্পনা এবং বৃহৎ আকারের ভৌত স্থান নকশা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ দেশে সম্পদ ও স্থান সীমিত। তাই এখানে সৃজনশীলতার জন্য দরকার অনেক বেশি দক্ষতা। এ কারণেই ক্রমে এই স্থপতি রাজনৈতিকভাবে বেশি সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় স্থপতিদের ভূমিকা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সেই ভূমিকা হবে বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার মোকাবিলা এবং রূপান্তর করার জন্য। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে আনুষ্ঠানিক স্থাপত্যকর্মের বাইরে রয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ গ্রামীণ এলাকাগুলোকে। মাজহারুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, স্থাপত্য একটি দীর্ঘ ও নিরলস সংগ্রামের ব্যাপার। এই সংগ্রাম ভীরু বা আপসকারীর জন্য নয়। তাঁর জীবন ছিল সেই চ্যালেঞ্জের মূর্ত প্রতীক।

কাজী খালিদ আশরাফ স্থপতি; বেঙ্গল ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক