‘অনিয়মের’ ক্ষতি ৪০ কোটি টাকা

ইউজিসি আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না।

মু. সিকান্দার খান, শিক্ষাবিদ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতারের জন্য ‘এয়ারমার্ক’ নামে একটি বাংলো বরাদ্দ রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি বাড়ি ভাড়া ভাতা নিচ্ছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিয়েছেন ৪ লাখ ১৯ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এটিকে ‘অনিয়ম’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, বাড়ি ভাড়া ভাতা বন্ধ করে প্রদত্ত অর্থ আদায় করতে হবে।

শুধু এটি নয়, এমন আরও ১০ ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে ইউজিসি। এ অনিয়মের কারণে তিন অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। এখন এসব অর্থ সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে ফেরত নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৯ লাখ টাকা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ কোটি ৯ লাখ টাকা ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরের ওপর অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহ আলম স্বাক্ষরিত ইউজিসির প্রতিবেদনটি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। আগের দুই অর্থবছরের প্রতিবেদন আলাদাভাবে পাঠানো হয়।

এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক অনিয়ম নিয়ে ২০২০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘যৌক্তিক সমাধান’ বের করতে কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ইউজিসির পর্যবেক্ষণগুলোর কয়েকটি বন্ধ করতে সুপারিশ করা হয়েছে। ইউজিসির এসব পর্যবেক্ষণের অধিকাংশই যৌক্তিক। আবার কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলাপ করার কথা বলা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ শিক্ষকেরা বলছেন, ইউজিসি আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। সিনেট সভাতেও এটি আলোচনা হলেও সমাধান আসে না। একেকটি অর্থবছর যায়, আর ইউজিসি নতুন করে আবার অনিয়ম ধরে।

এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণমানুষের অর্থে পরিচালিত হয়। এসব অনিয়মের ফলে মানুষের অর্থেরই অপচয় হয়। ফলে ইউজিসির পর্যবেক্ষণগুলোর মধ্যে যেসব আইন ও নৈতিকতা বিরোধী, সেসব অতি দ্রুত সমাধান করতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

যেসব খাতে অনিয়ম

যেসব শিক্ষকের এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে, তাঁদের অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্টসহ বেতন নির্ধারণ করেছিল কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে আপত্তি তুলে ইউজিসি বলছে, এটি জাতীয় বেতন স্কেলের লঙ্ঘন। এতে তিন অর্থবছরে ক্ষতি প্রায় তিন কোটি টাকা। বিধিবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেশন বেনিফিট দেওয়া হচ্ছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া উপাচার্য, ডিন, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর, আবাসিক শিক্ষক ও কর্মকর্তারা একাডেমিক অথবা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের স্ব স্ব মূল বেতনের ৬ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত মাসিক দায়িত্ব ভাতা নিচ্ছেন। এতে প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অন্যদিকে গত অর্থবছরের মতো এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পূর্ণ বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদানে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে ইউজিসি। ক্যাম্পাসের বাইরে বসবাসরতদের সিটি করপোরেশন এলাকার হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা দেওয়ায়ও আপত্তি তোলে সংস্থাটি। এ দুই খাতে তিন অর্থবছরে ক্ষতি হয়েছে ১৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া আরও কিছু অনিয়ম চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের মাসিক গবেষণা ভাতা প্রদান, যাতায়াত ভাতা, বই ভাতা প্রদান প্রভৃতি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গণমানুষের অর্থে পরিচালিত হয়। এসব অনিয়মের ফলে মানুষের অর্থেরই অপচয় হয়। ফলে ইউজিসির পর্যবেক্ষণগুলোর মধ্যে যেসব আইন ও নৈতিকতাবিরোধী, সেসব অতি দ্রুত সমাধান করা উচিত।
মু. সিকান্দার খান, শিক্ষাবিদ

উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার যা বললেন

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য শিরীণ আখতার প্রথম আলোর কাছে একটি চিঠি পাঠান। এ চিঠি তিনি সম্প্রতি ইউজিসির কাছেও পাঠিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, ২০০৭ সালে উপাচার্যের বাংলোর সঙ্গে লাগোয়া উত্তর-পূর্ব পাশের পাহাড় ধসে পড়ে। এরপর বাংলোটিও ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুপযোগী বলে ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো উপাচার্য স্থায়ীভাবে বাংলোতে বসবাস করেননি। বর্তমান উপাচার্যও স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, শিরীণ আখতার দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বাংলোর কিছু অংশ সংস্কার করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই দেশে প্রচলিত আইন, বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। কিন্তু এসব না মানার কারণে অনিয়মগুলো উঠে আসছে। বাড়ি ভাড়া ভাতার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ হচ্ছে, উপাচার্যকে সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হবে। পাশাপাশি গত জানুয়ারিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুশাসন দিয়েছেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বাংলোতে অবস্থান করতে হবে। বাংলো থাকলে বাড়ি ভাড়া ভাতা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলো পরিত্যক্ত করতে হলে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীর মাধ্যমে করতে হবে।

ইউজিসির পক্ষ থেকে অনিয়মের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের মতো করে বিষয়টি দেখবে বলে জানান তিনি।