অপারেশন সার্চলাইট

২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার যে অভিযান চালানো হয়, তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল। ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যানটিনের সামনে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল ২৭ মার্চ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত
২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার যে অভিযান চালানো হয়, তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল। ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যানটিনের সামনে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল ২৭ মার্চ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট। এই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এই নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়।

অনেক পরে, ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি নামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।

অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সে স্মৃতিচারণা করে খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিই এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’

পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তাঁর কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তাঁরাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।

>

গণহত্যা থেকে বিজয় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ পার হয়েছে বহু জটিল পথ। আনন্দ-বেদনাময় সে পথরেখার চিহ্ন ধরা আছে রাশি রাশি নথিপত্রে। নির্বাচিত কিছু নথির মধ্য দিয়ে আমরা দেখব মহত্তম সেই সময়টিকে।

পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা মেশিন: ২৫ মার্চ রাতে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের জানালা দিয়ে এই ছবি তুলেছিলেন গামা প্রতিষ্ঠানের আলোকচিত্রী।  ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা মেশিন: ২৫ মার্চ রাতে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের জানালা দিয়ে এই ছবি তুলেছিলেন গামা প্রতিষ্ঠানের আলোকচিত্রী। ছবি: সংগৃহীত

খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ‘(পরিকল্পনা হলো) ফরমান ঢাকা সেনানিবাসের অভিযান তত্ত্বাবধান করবেন আর আমাকে দেওয়া হবে এর বাইরে গোটা প্রদেশের দায়িত্ব। এরপর অভিযানের ভূমিকা আর ঢাকায় কী করে অপারেশন চলবে, তা ফরমান লিখলেন।...আগের আয়োজন অনুযায়ী, আমরা আবার ১৮ মার্চের বিকেলে কমান্ড হাউসে মিলিত হই। সেখানে চূড়ান্তভাবে, আমি প্রস্তাব ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করি। কোনো আলোচনা ছাড়াই এই পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়।’

অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার দেওয়া তথ্য তাঁরই জবানিতে নিচে দেওয়া হলো।

১. যেকোনো অভ্যুত্থানকে সরাসরি বিদ্রোহ হিসেবে দেখা হবে এবং কঠোর হাতে দমন করা হবে।

২. সফলতা নিশ্চিত করার জন্য চমক ও ধোঁকার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রেসিডেন্টকে আমরা এই চাতুরীতে শরিক হতে ও সহায়তা করতে প্রস্তাব করি।

৩. পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাঙালি সৈন্য ও পুলিশকে নিরস্ত্র করতে হবে। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিদ্রোহীদের মধ্যে বিতরণের আগেই পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, রাজারবাগে রিজার্ভ পুলিশের অস্ত্রাগার এবং চট্টগ্রামের অস্ত্রাগারে থাকা ২০ হাজার রাইফেলের দখল নেওয়া।

৪. অপারেশনের শুরুতে বাইরের ও ভেতরের সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে আবার তা চালু করা হবে।

৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো ঘিরে ফেলতে হবে। অস্ত্র ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করতে হবে।

৬. শেখ মুজিবকে জীবিত ধরতে হবে। আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় ১৫ জন নেতার বাড়ি তল্লাশি করতে হবে। তাঁদের পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করতে হবে।

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানোর সব আশা শেষ হয়ে এল। একাত্তরের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতে আমাকে অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হলো। ২৫ মার্চ দুপুরের পরপরই সংকেত দেওয়া হলো, ‘অগ্রসর হও’।