অপেক্ষার জীবন তাঁদের
কারো হাতে প্লাস্টিকের ফাইল, কারো হাতে লেমিনেটিং করা ‘সন্ধান চাই’ প্ল্যাকার্ড আর কেউবা নিজেদের চিকিৎসার কাগজ হাতে। রানা প্লাজা ধসের ১০০ দিনে স্বজন হারানোর কান্না আর হাহাকার ছাপিয়ে দাবি উঠেছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের। চরম বাস্তবতার মুখোমুখি এই মানুষগুলোর কেউ এখনো স্বজনের লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন। আহতরা করছেন সুস্থ জীবনে ফেরার অপেক্ষা আর নিহতদের স্বজনেরা যথাযথ ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায়।
রানা প্লাজার ৫৬ শতাংশ (প্রায়) জায়গায় এখন বৃষ্টির পানি জমে স্বচ্ছ জলাশয়ের মতো হয়ে রয়েছে। পুরো জায়গাটা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। স্থানীয়রা বলছেন প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রানা প্লাজায় আহত-নিহতদের স্বজনেরা এসে কাঁটাতার ধরে বসে থাকেন। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আর সুচিকিৎসার দাবিতে রানা প্লাজার সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
গতকাল শুক্রবার সকালে এমন দুটি সংগঠনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে জড়ো হয়েছিলেন শতাধিক শ্রমিক ও তাঁদের স্বজনেরা। গত মঙ্গলবারও শ্রমিকেরা এখানে জড়ো হয়েছিলেন। এই দুইদিন কথা হয় অনেক শ্রমিকের সঙ্গে। কারও ঘনিষ্টজন মারা গেছেন- ক্ষতিপূরণ পাননি, কেউ সন্তানের লাশটিও পাননি, কারো সুচিকিৎসা হচ্ছে না, কেউ পঙ্গু হতে চললেও কোনো ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য পাচ্ছেন না- এমন নানা অভিযোগ এই লোকগুলোর।
রানা প্লাজা ধসে পড়ার সময় সেখানে কতো লোক ছিলেন তার কোনো হিসেব নেই। সরকারি হিসেবে ভবন ধসের পর ঘটনাস্থল থেকে ২ হাজার হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত অবস্থায় ও ১ হাজার ১১৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। জীবিত উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে ১৬ জন পরে হাসপাতালে মারা যান। রানা প্লাজার দুইজন উদ্ধারকর্মীও মারা যান। সব মিলিয়ে ১ হাজার ১৩৩ টি লাশের মধ্যে ৮৪২ টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ২৯১ টি লাশ দাফন করা হয়েছে জুরাইন কবরস্থানে।
পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র অতিরিক্ত সচিব জগলুর হায়দার বলেন, তাঁদের হিসেবে দুই উদ্ধারকর্মীবাদে মোট নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ১৩২ জন। ধসের সময় ভবনে কতো লোক ছিল জানতে চাইলে তিনি, জীবিত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার হওয়াদের সংখ্যা যোগ করে জানান ৩ হাজার ৫৫৩ জন।
তবে সেখানে আসলে কতো লোক ছিলেন তার কোনো দালিলিক প্রমাণ মেলেনি কারো কাছ থেকে।
লাশের দাবিদার ৫৫৩ জন: মঙ্গলবার রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হলো যাঁরা স্বজনের লাশটিও পাননি। এরকম পরিবারের লোকেরা বলছেন, তাঁরা কোনো রকম সাহায্যও পাননি।
এরকমই একজন সাভার মজিদপুরের বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়া খোঁজ পাননি তাঁর স্ত্রী মুসলিমার। পঞ্চাশোর্ধ্ব ইদ্রিস মিয়ার এক চোখে নেই। তিনি বলেন, বিয়ের প্রায় ১৫ বছর পরে তাঁদের সন্তান হয়। সেই ছেলের বয়স এখন দুই বছর। চোখের সমস্যা থাকায় তিনিও বিশেষ কাজ করতে পারেন না। নিজের দৈনন্দিন কাজগুলোর জন্যও অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাঁর। স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে খুব কষ্টে আছেন শিশুপুত্রকে নিয়ে।
চার বোনের একটি মাত্র ছোটভাই ছিলেন মো. বাবুল। বাবুলের বাবা জুব্বার আলী যখন মারা যান তখন বাবুলের বয়স ৭/৮ মাস। মা আর বোনেরা মানুষ করেন তাঁকে। বাবুলের বোন রোখসানা বেগম বলেন, ‘ভাইও গ্যালো ভাইয়ের সাথে কিছু পাইনো না। লাশটা পাইলেও তো মায়ের বুকডা একটু ঠাণ্ডা হয়।’ তিনি বলেন, বাবুলের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে লাশ শনাক্তের জন্য তাঁর মা অপুময় রক্ত দিয়ে এসেছেন।
সাভারের মজিদপুর, ইমান্দিপুর, বক্তারপুর, ব্যাংক কলোনি এলাকার লোকালয়গুলোতে প্রচুর মানুষ এখনও খুঁজে ফিরছেন নিখোঁজ স্বজনকে।
আদালতে জমা দেওয়া প্রধান কারাখানা পরিদর্শকের তালিকায় নিখোজের সংখ্যা ৩৭৯ জন। আর আদালতে পাঠানো জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিখোঁজ ৩৭৬ জন।
জুরাইন কবরস্থানে সারিসারি কবরে শুধু ডিএনএ নমুনার নম্বর লেখা। নমুনার সঙ্গে স্বজনদের দেওয়া নমুনা মিললেই কেবল কবরে দাফন হওয়া ব্যাক্তিরা পরিচয় পাবেন। আর স্বজনেরা পাবেন ক্ষতিপূরণ।
ক্ষতিপূরণ পাননি অনেক নিহতের পরিবার: গত ২২ জুলাই সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আফম রুহুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী ৭৫০ জন নিহত শ্রমিকের স্বজনদের দুই থেকে পাঁচ লক্ষ করে টাকা দিয়েছেন। এছাড়া হাত-পা কাটা পড়েছে এমন ২৪ জন শ্রমিককে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে।
তবে নিহত অনেক শ্রমিকের পরিবারই এখনও কোনো ক্ষতিপূরন পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। সাভারের ইমান্দিপুরের গাবতলা গ্রামের ভাড়া বাসায় দেখা হয় একটি মাদ্রাসার পাঁচক আবদুল মান্নানের সঙ্গে। মান্নানের ছেলে সাইফুল ইসলাম, পুত্রবধূ রাশিদা বেগম ও মেয়ে মাজেদা রানা প্লাজায় কাজ করতেন। ভবন ধসে রাশিদা নিহত হন, সাইফুল পায়ে আঘাত পেয়েছেন আর মাথায় আঘাত পেয়ে মাজেদা এখন প্রায় অপ্রকৃতস্থ। সাইফুল-রাশিদা দম্পতি দুই বছরের ছেলে ইসমাইলের দেখা শোনা করছেন মান্নান ও তাঁর স্ত্রী সাহারা খাতুন।
মান্নান বলেন, রাশিদা নিহত হওয়ার ঘটনায় তাঁরা কোনো ক্ষতিপূরণই পাননি। মাজেদা প্রায় অপ্রকৃতস্থ। মাথায় আঘাতের কারণে মাজেদা কখনো বেশি কথা বলেন, চোখে কম দেখেন, তাঁর মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো হয়। অর্থাভাবে মেয়ের চিকিৎসাও ঠিকমতো করাতে পারছেন না তিনি। বিনামূল্যে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার গাড়িভাড়া যোগাতে পারছেন না বলে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না। খোঁড়া পা নিয়েই ছেলে সাইফুল নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। চারদিকে শুধুই অন্ধকার দেখছেন বৃদ্ধ মান্নান।
আহত: ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে ১ হাজার ১৬৭ জন আহতের একটা তালিকা রয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ৮১ জন। তবে ঘটনার শিকার শ্রমিকেরা বলছেন, জীবিত উদ্ধার হওয়ারা সবাই কমবেশি আহত। এর মধ্যে অনেকেরই সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে হাত-পা হারানো আহতদের সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র দিলেও অন্যান্যরা প্রায় কিছুই পাননি। আহত শ্রমিকেরা যথাযথ চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় এদের কেউ কেউ ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কিছু সাহায্য পেয়েছেন বলে জানান।
মঙ্গলবার সকালে রানা প্লাজার সামনে দেখা মিললো, দেলজান বেগম ও পারভীন বেগমের। তাঁদের হাতে কিছু চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজ। দুজনেরই বয়স ৫০ এর বেশি। দেলজানের ছেলে রেজাউল করিম আর পারভীনের ছেলে আবদুল আলীম কাজ করতেন রানা প্লাজার একটি কারখানায়। ভবন ধসে দুজনেই মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে এখন পঙ্গু প্রায়। ছেলেরা আসতে পারেন না। তাই প্রতিদিনই মায়েরা আসেন এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতে। আশা একটাই যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়।
হাতে-পায়ে-মাথায় আঘাত নিয়ে অসংখ্য শ্রমিক এখনও বাসায় ধুঁকছেন। এদের কেউ চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। বিজিএমইএ’র অতিরিক্ত সচিব জগলুর হায়দার মঙ্গলবার জানান, তাঁদের হিসেবে ৯০ জনের মতো শ্রমিক বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
আহতদের অনেককেই এখন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সাভারের সিআরপিতে এরকম ৯০ জনের মতো প্রশিক্ষন নিচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আহত কর্মক্ষমদের চাকরি বা কাজের ব্যবস্থা করছে। অনেকে নিহত শ্রমিকদের শিশুদের দায়িত্ব নিয়েছেন।
স্বেচ্ছায় রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজে নিয়োজিত অনেক কর্মীও বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এদেরই একজন রফিকুল ইসলাম ধসের পরে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক জীবিত মানুষ ও লাশ বের করেছেন। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে ২২ দিন রাজধানীর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ছিলেন। এখন সাভারের চাপাইন এলাকার বাসায় আছেন, তবে কোনো কাজে যেতে পারেন না। গতকাল তাঁর বাসায় রফিকুল বলেন, ‘ঘুমাইতে পারি না। খালি চোক্ষে ভাসে। খালি রানা প্লাজায় গেলে একটু শান্তি পাই। তাই সকাল-বিকাল ওইখানে যাই।’