অবহেলার জবাব দিচ্ছেন রাব্বী

শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই তাঁর সংগ্রামের গল্প পাঠ্যবইয়ে স্থান করে নিয়েছে। অন্য শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে তাঁর সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির ‘কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’ বইয়ে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এই শিক্ষার্থীকে নিয়ে ‘অবহেলার জবাব দিয়েছে রাব্বী’ শিরোনামে ২০১০ সালেপ্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। সে প্রতিবেদনটিই ২০১৩ সাল থেকে ষষ্ঠ শ্রে​িণর শিক্ষার্থীদের পাঠ্য।

সেই তৌফাতুর রাব্বী এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমেও মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তিনি। এখনো অবজ্ঞা ও অবহেলার জবাব দিয়ে চলেছেন তিনি। গত অক্টোবর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘হেনরি ডুনান্ট মুট কোর্ট’ প্রতিযোগিতায় রাব্বীর দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন হয়। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ডুনান্ট স্মরণে এই মুট কোর্ট (কল্পিত মামলার বাদী বা বিবাদীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন) প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। একমাত্র দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হিসেবে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি।

প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, অস্ট্রেলিয়ার ম্যাক্যুইয়ার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ সিদ্দিকী।

এর আগে গত বছরের আগস্টে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মডেল ইউনাইটেড নেশন (ছায়া জাতিসংঘ) প্রতিযোগিতায় সেরা ডেলিগেট নির্বাচিত হন রাব্বী। এই প্রতিযোগিতায়ও রাব্বী ছাড়া আর কোনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ছিলেন না।

অথচ দৃষ্টিহীন বলে রাব্বীকে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে আপত্তি করেছিল চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে সেই অবহেলার জবাব দিয়েছিলেন রাব্বী। তাঁর সংগ্রাম এখনো চলছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত রাব্বী প্রতিবারই প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

রাব্বী সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক জসিম আলী চৌধুরী বলেন, ‘রাব্বী আমাদের সম্পদ। সে ডিজঅ্যাবল নয়, ডিফরেন্ট অ্যাবিলিটির। আমাদের ২০ জন মুটারের মধ্যে রাব্বী সেরাদের একজন। লেখাপড়ায়ও সে ভালো। যদি শ্রুতলেখক ছাড়া পরীক্ষায় বসতে পারত, তাহলে সে সবার সেরা হতো। তার গবেষণা, শেখা এবং জানার আগ্রহ অন্য অনেক স্বাভাবিক শিক্ষার্থীকে হার মানায়।’

জন্মগতভাবে দৃষ্টিহীন রাব্বী। বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন। মা তাহরীর-ই-শাহনাজ শিক্ষকতা করেন। চট্টগ্রামের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন রাব্বী। ওই বিদ্যালয়ে আর পড়ার সুযোগ না থাকায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় তাঁকে। দৃষ্টিহীন বলে কোনো বিদ্যালয় তাঁকে নিতে চায়নি। একটি বিদ্যালয় তাঁকে ‘অন্ধ’ বলে অবজ্ঞাও করেছিল।

বহু কষ্টে নগরের দামপাড়া পুলিশ ইনস্টিটিউট স্কুলে ভর্তি হন রাব্বী। এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে অবজ্ঞার জবাব দিয়েছিলেন। এইচএসসিতে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এ গ্রেডে উত্তীর্ণ হন।

রাব্বী বলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা সব সময় তাঁকে সাহায্য করেন। সবাই ভালো ব্যবহারও করেন। সুযোগ-সুবিধা পেলে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরাও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

ঢাকায় অনুষ্ঠিত মুট কোর্ট প্রতিযোগিতায় রাব্বীর দলের সদস্য ও তাঁর সহপাঠী শেখ হাবিবুর রহমান বলেন, তাঁকে কখনো প্রতিবন্ধী মনে হয় না। তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।

নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে রাব্বী এ পর্যন্ত এসেছেন বলে মন্তব্য করেন তাঁর বাবা মো. কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, মানুষের জন্য, দেশের জন্য কাজ করতে চান রাব্বি।