অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে বাংলাদেশ

দেশব্যাপী টিকাদান কর্মযজ্ঞ চলছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে ঘণ্টায় ১৪ হাজার মানুষ টিকার নিবন্ধন করেছেন। টিকাকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট মানুষ।

দেশে প্রতিদিন দুই লাখের বেশি মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকা দেওয়ার দৈনিক হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ওপরের দিকে। টিকা দেওয়ার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং এ-সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার কারণে বাংলাদেশ অল্প সময়ে বেশি মানুষকে করোনার টিকার আওতায় আনতে পেরেছে। এই মুহূর্তে দিনে পৌনে চার লাখের বেশি টিকা দেওয়ার সক্ষমতা আছে সরকারের। চাহিদা অনুযায়ী এই সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তুতিও আছে।

করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও করোনার টিকা এখনো সব দেশে পৌঁছায়নি। অনেক দেশ টিকা জোগাড় করতে পারেনি। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, বিশ্বের ১৩০টি দেশ এখনো কোনো টিকা পায়নি।

এই তথ্য বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ টিকা শুধু সংগ্রহই করেনি, প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকা দিয়ে চলেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ২ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৫ জন মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। পরপর চার দিন গড়ে ২ লাখ ২৬ হাজারের বেশি মানুষকে টিকা দিতে পেরেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ পর্যন্ত দেশে ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৩১৩ জন করোনার টিকা নিয়েছেন।

নিবন্ধনের সংখ্যা আরও বাড়াতে সামাজিক শক্তি ও সংগঠনকে কাজে লাগাতে হবে। যাঁর দরকার, তিনি যেন টিকা পান, সে বিষয়ে আরও নজর দিতে হবে।
মুশতাক হোসেন, পরামর্শক, আইইডিসিআর

প্রতিদিন টিকা নেওয়ার হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে এগিয়ে আছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের চেয়ে এগিয়ে আছে দেশ। প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি টিকা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে দিনে ১৪ লাখের বেশি মানুষ টিকা নিচ্ছেন। যুক্তরাজ্যে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে ৮ ডিসেম্বর। দেশটিতে এ পর্যন্ত দেড় কোটি মানুষ টিকা পেয়েছেন। দেশটিতে গড়ে প্রতিদিন টিকা পেয়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। প্রতিবেশী দেশ ভারত টিকা দেওয়া শুরু করে ১৬ জানুয়ারি। ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮৫ লাখ ১৬ হাজার ৭৭১ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে বলে প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি জানিয়েছেন। অর্থাৎ দেশটিতে দৈনিক গড়ে ২ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৯ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

সরকারের গণটিকাদান কর্মসূচি সারা দেশে বড় ধরনের সাড়া ফেলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা সদরে দিনের অন্যতম বড় কর্মকাণ্ড এখন মানুষকে টিকা দেওয়া। টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহও বাড়ছে। মানুষ টিকা কেন্দ্রে আসার, টিকা নেওয়ার ছবি তুলছেন, সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। করোনার টিকা নেওয়া ও দেওয়া তাই সারা দেশে অনেকটাই উৎসবের আমেজ এনেছে। টিকাদান ব্যবস্থাপনা নিয়ে মানুষের মধ্যে স্বস্তিও আছে। অন্তত এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সরকারের সমালোচনার চেয়ে সুনামই বেশি শোনা যাচ্ছে।

গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাদান কেন্দ্রে টিকা নিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী সৈয়দ আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী। টিকাদান শেষে বিশ্রামের সময় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকার জন্য নিবন্ধন করতে কোনো ঝামেলা হয়নি। এখানে এসে টিকা নিতেও কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি, সময় নষ্ট হয়নি। সবকিছু সুন্দরভাবে হয়েছে।’

একই কেন্দ্রে গতকাল বেশ কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী টিকা নিয়েছেন। তাঁদের একজন সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘এত বড় একটা কাজ এত সুন্দরভাবে হচ্ছে, টিকা দিতে না এলে তা বুঝতে পারতাম না।’

অনেক বড় কর্মযজ্ঞ

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ১ হাজার ৬টি হাসপাতালে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ হাসপাতালে একাধিক বুথে টিকা দেওয়া হচ্ছে। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকাদানকেন্দ্রে বুথ আছে আটটি। এ রকম সারা দেশে ২ হাজার ৫৯০টি বুথে প্রতিদিন টিকা দেওয়া হয়।

প্রতিটি বুথের দিনে ১৫০ জনকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব।

প্রতিটি বুথে ছয়জন কর্মী। তাঁদের দুজন স্বাস্থ্যকর্মী এবং বাকি চারজন স্বেচ্ছাসেবক। তাঁদের মোট সংখ্যা ১৫ হাজার ৫৪০। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে চিকিৎসক, পরিসংখ্যানবিদ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, আনসার নিয়মিতভাবে কাজ করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারা দেশে সাত হাজারের বেশি বুথ চালু করার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল। প্রতিটি বুথে প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়ার সক্ষমতাও আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। বাংলাদেশ একসঙ্গে বেশি টিকা এলে ক্রমান্বয়ে বুথের সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনাও আছে।

নিবন্ধন বাড়ছে

গতকাল বেলা আড়াইটা পর্যন্ত করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন ২৮ লাখ ৫ হাজার ১৩৫ জন। রাত আটটায় সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৮২ হাজারে। প্রতি ঘণ্টায় ১৪ হাজারের মতো মানুষ টিকার জন্য সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করছেন।

খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার ইউএনও এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, নিবন্ধনে আগ্রহী করার জন্য তাঁরা গ্রামের হাটে হাটে প্রচার চালিয়েছেন। সাপ্তাহিক হাটের দিন নিবন্ধনের আয়োজন করেছেন। ওই উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৭০৪ জন নিবন্ধন করেছেন।

বগুড়া, ফেনীসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় নিবন্ধন মেলার আয়োজন করা হয়েছিল বলে প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। নীলফামারীতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা টিকার নিবন্ধন করতে মানুষকে সহায়তা করছেন।

‘ভ্যাকসিন হিরো’

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে টিকা দেওয়ায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। ১৯৭৯ সালে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ছয়টি সংক্রামক রোগের টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) শুরু হয়।

এখন শূন্য থেকে ১৫ মাস বয়সী সব শিশু, ১৫ বছর বয়সী কিশোরী এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম মহিলাকে টিকা দেওয়া হয়। বর্তমানে ইপিআইতে ১০ ধরনের টিকা দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টিকাদানের হার ৯৫ শতাংশ।

টিকাদানের এই হারকে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম বড় অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির অনন্য সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)।

পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি

সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশব্যাপী টিকা দেওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা বর্তমান সময়ে কাজে লেগেছে। তা ছাড়া অধিদপ্তর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করেছে।

করোনার টিকাদান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত বছর ডিসেম্বরে জাতীয় টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করে। ১২৯ পৃষ্ঠার সেই পরিকল্পনায় টিকা সংগ্রহ, কেনা, সংরক্ষণ, বিতরণ ও প্রয়োগ বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। এ ছাড়া টিকাকেন্দ্র স্থাপন, টিকা দেওয়া, টিকা দেওয়ার সময় সতর্কতা—এসব বিষয়ে নির্দেশনা পুস্তিকা আকারে ছেপেছে অধিদপ্তর। এ নিয়ে সারা দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘নিবেদিতপ্রাণ স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ রাখছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টির ওপর কড়া নজরদারি রেখেছেন। এসব কারণে এখন পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে টিকাদান চলছে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিবন্ধনের সংখ্যা আরও বাড়াতে সামাজিক শক্তি ও সংগঠনকে কাজে লাগাতে হবে। যাঁর দরকার, তিনি যেন টিকা পান, সে বিষয়ে আরও নজর দিতে হবে।’