অভিভাবকহীন রোগীর অভিভাবক

আলিয়া বেগম

আলিয়া হাসপাতালের ট্রলি টানেন। চিকিৎসকদের ফুটফরমাশ খাটেন। হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চোখ রাখেন কোথায় পড়ে আছে অভিভাবকহীন রোগী। তিনিই সেই সব রোগীর অভিভাবক হয়ে যান। চিকিৎসা করান। শুশ্রূষা দেন। সুস্থ হলে, পরিচয় পেলে ফিরিয়ে দেন অভিভাবকের কাছে। না পেলে প্রয়োজনে নিজের বাসায় রাখেন। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে চান না কিছুই। অসহায় মানুষের সেবা তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছে। এ জন্য সারা দিন হাসপাতালে থাকেন। তাতে সংসার চলে না। জীবিকার জন্য মূলত রাতে বাসায় ফিরে বই বাঁধাইয়ের কাজ করেন।

আলিয়ার বয়স এখন ৩৫। থাকেন রাজশাহী নগরের মুন্সীডাঙ্গা এলাকায়। ভাড়া বাড়িতে। সঙ্গে থাকেন তাঁর মা রওশন আর ও মেয়ে টুম্পা। সঙ্গে আরও একজন থাকে। তার নাম কেউ জানে না। সে নিজেও বলতে পারে না। হাসপাতালে পাওয়া ট্রেনের চাকার নিচে পড়ে হাত-পা কাটা একটি ছেলে। আলিয়ার সেবায় ছেলেটি বেঁচে যায়। একসময় সুস্থ হয়। সুস্থ রোগী আর হাসপাতালে রাখা যায় না। তাই তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সেই থেকে তার ঠিকানা হয়েছে আলিয়ার বাড়ি। আলিয়া নিজে যা খান, ছেলেটিও তা–ই খায়। আলিয়া তার নাম দিয়েছেন বোল্টু। বোল্টু এখন তাঁর পরিবারের সদস্য।

আলিয়ার পৈতৃক নিবাস ছিল সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খাগা গ্রামে। একসময় জীবিকার প্রয়োজনে আলিয়ার মা চলে এলেন রাজশাহী শহরে। ১৯৯৯ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মা তাঁকে বিয়ে দেন। কিন্তু চাহিদামাফিক যৌতুকের টাকা দিতে না পারার কারণে তিন বছরের মাথায় তাঁকে ফেলে চলে যান তাঁর স্বামী। তখন মেয়ে টুম্পার বয়স মাত্র দেড় বছর। মায়ের মতোই আলিয়ার জীবনে নেমে এল অন্ধকার।

দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলেন আলিয়া। কাজ নিলেন বই বাঁধাইয়ের। তখন এক হাজার পৃষ্ঠা বাঁধাই করলে পান ২৫ টাকা। তাতেও সংসার চলে না। এ সময় পরিচয় হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নূরজাহান বেগমের সঙ্গে। তিনি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই থেকে হাসপাতালে ট্রলি ঠেলতে শুরু করেন তিনি। এখন হাসপাতালে দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকের (পরিচ্ছন্নতাকর্মী) কাজ করেন। একদিন তাঁর চোখের সামনেই অভিভাবকহীন দুজন মানুষ মারা গেল। তাদের কোনো পরিচয় জানা গেল না। বিষয়টি চরমভাবে নাড়া দিল তাঁকে। মূলত তখন থেকেই অভিভাবকহীন রোগী হাসপাতালে এলেই ছুটে যান আলিয়া। মুখে একটু পানি দেন, বাঁচানোর চেষ্টা করেন। নিজের টাকা দিয়েই কিনে আনেন জরুরি ওষুধ। মানুষটাকে সুস্থ করে তুলতে পারলেই তাঁর মুখে হাসি ফোটে। এমন শতাধিক মানুষকে সুস্থ করে পরিবারের কাছে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আলিয়া বলেন, কেউ এ কাজের বিনিময়ে জোর করে টাকা দিলে তিনি কষ্ট পান। মনে হয় তাঁর আনন্দটা ফুরিয়ে গেল। নিজেকে বিক্রি করে দিলেন।

১৪ ডিসেম্বর হাসপাতালে আলিয়ার কাছে সাতজন অভিভাবকহীন রোগী ছিলেন। তাঁরা কেউ কথা বলতে পারেন না। নিজের বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেন না। আলিয়া জানান, এই শীতে তাঁর রোগীরা খুবই কষ্টে আছেন। তিনি তাঁদের কম্বলের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন। খাবার ধরছেন। আবার মলমূত্র পরিষ্কার করতে হচ্ছে। সারা দিন তাঁর দম ফেলার সময় নেই। রোগী বেশি হলে সেই সকালে হাসপাতালে যান আর গভীর রাতে ফিরতে হয়। হাসপাতালে দৈনিক মজুরির শ্রমিক হিসেবে যা পান তা দিয়ে তাঁর সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে রাতের বেলায় বই বাঁধানোর কাজ করেন। এক হাজার পাতা সেলাই করলে এখন ১০০ টাকা পান। ক্লান্ত হয়ে রাতে বাড়ি ফেলার কারণে আর বেশি বই বাঁধাই করতে পারেন না।

একদিন জরুরি প্রয়োজনে ঢাকায় যেতে পারবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এদের ফেলে তিনি কোথাও যেতে পারবেন না। তিনি না থাকলে এরা না খেয়ে মরে যাবে। এদের মলমূত্র কেউ পরিষ্কার করবেন না। এদের খুব কষ্ট হবে। তিনি সহ্য করতে পারবেন না। এমনিতেই রাতে তিনি বাসায় লেপের ভেতরে শুয়ে থাকেন আর রোগীরা হাসপাতালের মেঝেতে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকে, তার খুব কষ্ট হয়।