অমর গানের রচয়িতা গাফ্‌ফার চৌধুরী

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (জন্ম ১৯৩৪—মৃত্যু ২০২২)

গত ১৩ এপ্রিল আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী লন্ডনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুনতে পান মেয়ে বিনীতা চৌধুরী মারা গেছেন। চার মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে বিনীতা ছিলেন সবার ছোট। তিনি ক্যানসারে ভুগ‌ছি‌লেন। বাবার কাছে কন্যার মৃত্যুসংবাদ কতটা শোকাবহ, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সেই শোকের আবহ না কাটতেই গতকাল খবর এল গাফ্‌ফার চৌধুরী নেই। তিনিও কন্যার সহযাত্রী হলেন।

কন্যার মৃত্যু ছিল বাবার জন্য অত্যন্ত বেদনার। কিন্তু আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আমাদের প্রজন্ম, তাঁর পরের ও আগের প্রজন্মও যাঁকে জানতেন গাফ্‌ফার ভাই হিসেবে, তাঁর মৃত্যুসংবাদ গোটা দেশের জন্যই শোক এবং বেদনার। সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি লন্ডনে থাকতেন, মাঝেমধ্যে দেশে আসতেন। কিন্তু তাঁর মননে, চিন্তায় বাংলাদেশ সদা জাগরূক ছিল। দেশে থেকেও আমরা অনেকে রাজনীতির অন্দরমহলের যেসব খবর পেতাম না, গাফ্‌ফার ভাই তা পেয়ে যেতেন। গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন বেশ কয়েকটি পত্রিকায়। তিনি বলতেন, তাঁর সকাল হতো লেখা দিয়ে, আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগেও লিখতে হতো।

বর্তমান প্রজন্মের পাঠক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে জানেন একজন কলাম লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, জেল খেটেছেন। আবার ভাষাশহীদদের স্মরণে লিখেছেন অমর পঙ্‌ক্তি, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি/ ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি।’

আরও পড়ুন

এই গানের কথা ও সুর এতটাই মানুষকে আন্দোলিত করেছে যে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।

গাফ্‌ফার চৌধুরীর সাংবাদিকতার শুরু গত শতকের পঞ্চাশের দশকে, যখন তিনি কলেজের গণ্ডিও পার হননি। এরপরও লেখালেখি, সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক আন্দোলন চলেছে সমান্তরালে। ষাটের দশকে তিনি ছয় দফা তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। তাঁর সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ–এ প্রথম ছয় দফার পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে শুধু শহীদদের প্রতি শোকগাথা বা আহাজারি নয়, এই গানটিতে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে, আছে শত্রুর প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ আর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিকে জাগানোর উদীপ্ত আহ্বান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই গানের মাধ্যমে যে সমাজ ও রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী সপরিবার আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র জয় বাংলা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। পত্রিকাটি তথ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নানের নামে প্রকাশিত হলেও প্রধান নির্বাহী ছিলেন তিনি। এ ছাড়া গাফ্‌ফার চৌধুরী আনন্দবাজার পত্রিকাযুগান্তর–এও লিখতেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে নিয়মিত তাঁর কথিকা প্রচারিত হতো। সে সময় কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে, যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল।

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যখন দেশ সামরিক শাসনে পিষ্ট, চারদিকে ঘাতকের উল্লাস এবং মানবতার লাঞ্ছনা চলছিল, যখন কেউ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নিতে সাহস পেতেন না, দূর প্রবাসে বসে তিনি ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে সহযাত্রীদের নিয়ে তিনি ক্রোড়পত্র বের করে নিহত জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন; তাঁর সেই প্রতিবাদী পঙ্‌ক্তিমালা সামরিক শাসকের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে সরাসরি প্রবেশাধিকার পায়নি; তখন কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে বিমানযোগে পৌঁছানো হতো সেই পত্রিকা এবং পরে বাংলাদেশে আসত। পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রায় অর্ধদশক ধরে যখন দেশে সেই অবরুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল, তখন শওকত ওসমান ও আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর গদ্য, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা প্রমুখের কবিতা আমাদের উজ্জীবিত করত, আশা জাগাত। এখন অনুকূল পরিবেশে অনেকেই বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নাম ব্যবহার করে নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন; কিন্তু সেই প্রতিকূল পরিবেশে তাঁদের অনেকে ছিলেন নিশ্চুপ। এমনকি কেউ কেউ সামরিক শাসকদের সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেননি।

গাফ্‌ফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে তাঁর শাসনামলের সমালোচনা করেছেন, পঁচাত্তরের মার্চে ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো’ শিরোনামে কলাম লিখে সমূহ বিপদের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু পঁচাত্তরের নির্মম ঘটনার পর উপলব্ধি করেছেন, এই হত্যাকাণ্ড তো ব্যক্তি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নয়, বাংলাদেশে অস্তিত্ব ও প্রাণসত্তার বিরুদ্ধে। ৪৭ বছর ধরে গাফ্ফার চৌধুরী সেই অমোঘ সত্যই উচ্চারণ করে গেছেন তাঁর কলামে, বক্তৃতায়, নাটকে ও অন্যান্য রচনায়।

‘বাঁচতে চাইলেই বাঁচবে এমন কথা তো নেই প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতে আট লাখ শিশু, নারী ও পুরুষ আজকে নেই মরে গেছে তারা এক রাতে।’

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনন্য সৃষ্টি। তিনি যদি আর কিছু না–ও লিখতেন, এই একটি গান তাঁকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে মিছিলে মুসলিম লীগ সরকার গুলি চালিয়ে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত প্রমুখকে হত্যা করে, সেই মিছিলে গাফ্ফার চৌধুরীও ছিলেন পেছনের সারিতে; তাই অগ্রভাগে যাঁরা গুলিবিদ্ধ হন, তিনি তাঁদের দেখতে পাননি; পরে দেখেছেন। একুশের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:

‘আমরা আউটডোরের সামনে গিয়ে দেখি একটি লাশ পড়ে আছে। সাদা প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট গায়ে, পায়ে জুতোও আছে, গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে গেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় লাশটি পড়ে আছে। সেই লাশটি দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমিয়েছে। রফিকুল ইসলাম সম্ভবত তাঁর ছবি নিয়েছিলেন। পরে জানলাম যে এই লাশ হুবহু শহীদ রফিকউদ্দিনের। এই লাশটি দেখার সময়ে আমার মনে কবিতা লেখার জন্য একটি ভাবের উদয় হয়েছিল। ভাবটি এসেছিল কবিতা লেখার জন্য, গান রচনার জন্য নয়। আমি গান লিখতে জানি না, আমি সুরকারও নই, গীতিকারও নই, একটি কবিতা লেখার জন্য আমার মনে যে লাইনটি এসেছিল, তা হলো, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?”’ (নেপথ্য কাহিনী: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি: লুৎফর রহমান রিটন সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী।)

গাফ্‌ফার চৌধুরী আরেকটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর। পাকিস্তানি সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান ইতিহাসের বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়কে অগ্রাহ্য করে চীন সফরে গেলেন। চীন থেকে ফিরে ঢাকায় যাত্রাবিরতি করলেও দক্ষিণাঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের পর ঘূর্ণিঝড়দুর্গত মানুষকে দেখতে গেলেন না।

গাফ্‌ফার চৌধুরী লিখলেন:

‘বাঁচতে চাইলেই বাঁচবে এমন কথা তো নেই

প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতে

আট লাখ শিশু, নারী ও পুরুষ আজকে নেই

মরে গেছে তারা এক রাতে।’

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর গানটি প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন–এ, ১৯৫৩ সালে। এর আগেই গাজীউল হক ও আবদুল লতিফ একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মরণে দুটি গান লিখেছিলেন। আর ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনা শুনে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই চট্টগ্রামে বসে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছিলেন, তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আমি আজ ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে শুধু শহীদদের প্রতি শোকগাথা বা আহাজারি নয়, এই গানটিতে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে, আছে শত্রুর প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ আর নিপীড়িত মানুষের ক্ষুদ্র শক্তিকে জাগানোর উদীপ্ত আহ্বান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এই গানের মাধ্যমে যে সমাজ ও রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, তা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

এই গান কেবল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কিংবা এর সুরকার আলতাফ মাহমুদকেই অমর করেনি, বাঙালির চেতনাকেও করেছে তীক্ষ্ণ ও শাণিত। আমরা প্রতিবছর একুশের প্রভাতফেরিতে এই গান গেয়ে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই। আসলে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবতার চিরন্তন জাগৃতির গান। এই গান অবিস্মরণীয়।

গানের কয়েকটি পঙ্‌ক্তি এখানে তুলে ধরছি:

‘ওরা এ দেশের নয়,

দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়

ওরা মানুষের অন্ন বস্ত্র শান্তি নিয়েছে কাড়ি

একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।

তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি

আজও, জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী

আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে

জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে।’

আলতাফ মাহমুদের জীবন ও সংগীত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সংস্কৃতিকর্মী দিনু বিল্লাহ লিখেছেন: ‘“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি” আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত কবিতায় কালাতীত ধ্রুপদি সুর সৃষ্টি করে বাঙালির রক্তঝরা ইতিহাসের সঙ্গে শহীদ আলতাফ মাহমুদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’

তবে এই গান ও সাংবাদিকতাই গাফ্‌ফার চৌধুরীর সব নয়। তিনি খ্যাতনামা কথাশিল্পী ছিলেন। সম্রাটের ছবি নামে তাঁর একটি বিখ্যাত গল্প সংকলন আছে। আছে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ও নাটক। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে আমরা তাঁকে পাই একজন সক্রিয় প্রগতিশীল লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে। তিনি ইতিহাসের পর্যবেক্ষক ছিলেন না কেবল, ছিলেন তার অংশীদারও।

ইতিহাসের সহযাত্রী আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।