অর্থ ও বাণিজ্যের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তবু নীরব

পাঁচ মাস পর অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি আজ বৈঠক ডাকলেও আলোচ্যসূচিতে অর্থনীতির চলমান অস্থিরতার বিষয়টি নেই।

  • বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গত ফেব্রুয়ারির পর আর কোনো বৈঠক করেনি।

  • মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটিগুলোর মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা আছে।

ফাইল ছবি

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করেছে, যার প্রভাব দেশেও পড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান দফায় দফায় কমানো হয়েছে, রিজার্ভ আগের চেয়ে কমেছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতির সম্ভাব্য সংকট নিয়ে নানামুখী আলোচনা চললেও অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই কমিটি সর্বশেষ বৈঠক করেছিল গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর।

অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মতোই নীরব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও। গত ফেব্রুয়ারি মাসের পর এই কমিটি আর কোনো বৈঠক করেনি। অথচ গত প্রায় তিন মাসে চাল, ডাল, তেলসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সংকটে আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চললেও সংসদীয় কমিটি চুপচাপ।

এদিকে প্রায় পাঁচ মাস পর আজ সোমবার বৈঠকে বসছে অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তবে দেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এই বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে জায়গা পায়নি। সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, সংসদীয় কমিটির আজকের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে আছে গত বৈঠকের কার্যবিবরণী নিশ্চিতকরণ, ‘পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস বিল’ পরীক্ষাকরণ ও বিবিধ। অবশ্য কমিটির কোনো সদস্য চাইলে বিবিধতে অন্য কোনো বিষয় আলোচনায় আনতে পারেন।

জাতীয় স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করা উচিত। এখন অর্থনীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। এখন কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সংসদীয় কমিটি সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে। এটা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।
ইফতেখারুজ্জামান, সংস্থার নির্বাহী পরিচালক

অর্থমন্ত্রীসহ অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ১০ জন। এর মধ্যে বিরোধী দল থেকে আছেন দুজন। একজন জাতীয় পার্টির রানা মোহাম্মদ সোহেল, অন্যজন বিএনপির হারুনুর রশীদ।

সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে অবশ্যই আলোচনা হওয়া উচিত। প্রায় পাঁচ মাস পর বৈঠক ডাকা হলেও যথাসময়ে এই বৈঠকের নোটিশ না পাওয়ায় সোমবারের (আজ) বৈঠকে থাকতে পারছেন না। তিনি বলেন, রোববার (গতকাল) দুপুরে তিনি বৈঠকের খবর পেয়েছেন। ততক্ষণে তিনি ঢাকা থেকে নিজের নির্বাচনী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। তিনি বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈঠকের কোনো কার্যপত্র তাঁর কার্যালয়ে পৌঁছানো হয়নি। শুধু জানতে পেরেছেন, মূলত একটি বিল নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠক ডাকা হয়েছে।

বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, অর্থনীতিতে সংকট চলছে। সংসদীয় কমিটির বৈঠকের বিষয় আগেভাগে অবহিত করা হলে মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য, ডলারের বাজার এসব নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুতির সুযোগ পেতেন। এভাবে যথাযথ সময় না দিয়ে বৈঠক ডাকা অর্থহীন। এর আগেও বিভিন্ন বৈঠকে অর্থনীতির বিষয়ে কথা বলতে গেলে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। অনেক সময় তড়িঘড়ি করে বৈঠক শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এই সংসদীয় কমিটির বৈঠক কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সভাপতি বৈঠক না ডাকলে অন্য সদস্যের কিছু করার থাকে না।

‘কোভিডের জন্য, আপনি জানেন না সব বন্ধ, মিটিং হয় না? এগুলো করা যায়? টু রিস্কি।’
আবুল হাসান মাহমুদ আলী, অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটিগুলোর মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা আছে। তবে বেশির ভাগ সংসদীয় কমিটিই এই নিয়ম মানছে না। যেসব সংসদীয় কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে না, তার একটি অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। চলতি সংসদে ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়। এরপর গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে এই কমিটি বৈঠক করেছে মাত্র আটটি।

বৈঠক নিয়মিত কেন হয় না, তা জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেন, ‘কোভিডের জন্য, আপনি জানেন না সব বন্ধ, মিটিং হয় না? এগুলো করা যায়? টু রিস্কি।’

আজকের বৈঠকের আলোচ্যসূচির বিষয়েও কিছু বলতে রাজি হননি মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, বৈঠকের পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সব জানানো হবে।

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সংসদীয় কমিটির কাজ সংসদ থেকে পাঠানো যেকোনো বিল বা বিষয় পরীক্ষা করা এবং কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা করা। মন্ত্রণালয়ের কাজ বা অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা এবং কমিটি যথোপযুক্ত মনে করলে কমিটির আওতাধীন যেকোনো বিষয় সম্পর্কে পরীক্ষা করা ও সুপারিশ করা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি যে আটটি বৈঠক করেছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে মূলত বিল পরীক্ষা করার জন্য।

গত এপ্রিলে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন বিরোধী দলের সদস্যরা। এখন অধিবেশন না থাকায় এসব নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগ নেই। যখন সংসদ অধিবেশন থাকে না, তখন সংসদীয় কমিটিগুলোতে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার সুযোগ থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে অর্থনীতি ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মাসে একাধিকবার আলোচনা হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা বলেন, সংসদীয় কমিটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দুটি কমিটিই নিষ্ক্রিয়।

গত ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে ‘বাণিজ্য সংগঠন বিল’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরপর গত তিন মাসে এই কমিটি আর বৈঠক করেনি। এর আগে গত বছরও (২০২১ সাল) এই কমিটি কোনো বৈঠক করেনি। এই কমিটির সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড পরিস্থিতির কারণে বৈঠক কম হয়েছে।

২০২০ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ওই বৈঠকে আলু ও পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতে অন্তত পাঁচ–ছয় মাস আগে কোন কোন পণ্যের চাহিদা কত, তা নিরূপণ করতে বলা হয়েছিল। একই সঙ্গে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী এবং আমদানিকারকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সংকট যাতে না হয়, সে জন্য মজুত রাখাসহ প্রয়োজনীয় সুপারিশ করেছিল। এ ছাড়া কখনো এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা মোকাবিলা করার জন্য অর্থ, বাণিজ্য, কৃষি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবদের সমন্বয়ে বৈঠক করে সমস্যা চিহ্নিত করা এবং তা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল।

জাতীয় সংসদ ও সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম নিয়ে নিয়মিত গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় স্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করা উচিত। এখন অর্থনীতির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত। সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। এখন কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সংসদীয় কমিটি সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে। এটা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে।

সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংসদীয় কমিটি মানুষের ও দেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি মন্ত্রণালয়কে কার্যকর সুপারিশ করতে পারে, দিকনির্দেশনা পেতে পারে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সংসদীয় কমিটি সেটিও চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতিতে একধরনের অস্থিরতা চললেও সংসদীয় কমিটি নীরব থেকে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে।