অস্তিত্বের লড়াইয়ে মণিপুরি তাঁত

তাঁতের কাপড় বুনন করছেন মণিপুরি নারীরা। সম্প্রতি সিলেট নগরের মণিপুরি তাঁত শিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্রে।  প্রথম আলো
তাঁতের কাপড় বুনন করছেন মণিপুরি নারীরা। সম্প্রতি সিলেট নগরের মণিপুরি তাঁত শিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্রে। প্রথম আলো

সালটা ১৯৮৬। ঢাকায় আয়োজিত জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রদর্শনীতে প্রথম স্থান অর্জন করে মণিপুরি তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র। সংগঠনটি সিলেটের মণিপুরিদের তৈরি তাঁত ও হস্তশিল্পের পণ্য নিয়ে প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিল। সে সময় আয়োজক ও দর্শনার্থীদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রদর্শিত মণিপুরি শাড়ি, চাদর, ওড়না, গামছা, মাফলার, বিছানার চাদর ও নকশিকাঁথার পণ্য।

তবে বর্তমানে পৃষ্ঠপোষকতা, রক্ষণাবেক্ষণ, দিকনির্দেশনা এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে মণিপুরিদের ঐতিহ্য তাঁতশিল্প। বুননশিল্পে দক্ষ অধিকাংশ মণিপুরি তাঁতি নিজেদের পেশা বদল করেছেন জানিয়ে মণিপুরি যুব সমিতির সভাপতি ধীরেন সিংহ বলেন, মণিপুরিদের হাতে তৈরি তাঁতশিল্পের সুনাম থাকলেও এখন অনেকেই সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং তাঁতশিল্পীদের কম পারিশ্রমিক দিয়ে ব্যবসায়ীরা লাভবান হওয়ায় শিল্পীরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তরুণেরাও এ পেশায় না আসা অন্য একটি কারণ। কিন্তু মণিপুরি নারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ জন্মসূত্রেই তাঁতশিল্পের সঙ্গে পরিচিত। প্রথম দিকে নিজেদের জন্য কাপড় বুনলেও পর্যায়ক্রমে সেটি বাণিজ্যিকভাবে রূপ নেয়।

মণিপুরি যুব সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক লারু সিংহ বলেন, মণিপুরি তাঁত ও হস্তশিল্প হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে মণিপুরিদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন ভাবনা থেকেই ১৯৭৭ সালে মণিপুরি তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সিলেট নগরের শিবগঞ্জ এলাকায় ৪৮ শতক জমি লিজ নিয়ে মণিপুরি সংস্কৃতির ঐতিহ্য তাঁত ও হস্তশিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে মণিপুরি যুব সমিতি নামের সংগঠনের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয় মণিপুরি তাঁতশিল্প ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। প্রশিক্ষণকেন্দ্রটির মাধ্যমে একসময় হারিয়ে যেতে বসা মণিপুরিদের নিজ হাতে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশে কাজ ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৭৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেড় শতাধিক তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সংগঠনের মাধ্যমে। তবে প্রশিক্ষিত তাঁতিরা অনেকেই বর্তমানে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁতশিল্পের পেশা ছেড়ে অনেক তাঁতি বর্তমানে বিভিন্ন পোশাক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

প্রশিক্ষিত তাঁতিদের সাতজন জানান, সুতার মূল্য বৃদ্ধি, বাজারের সীমাবদ্ধতা এবং কম পারিশ্রমিকের কারণে পেশা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সাংগঠনিকভাবে এটি পরিচালিত হয়ে এলেও ২০১১ সালের শেষ দিকে মণিপুরি তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন নামের একটি প্রকল্পে যোগ হয়। এর মাধ্যমে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৬০ জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২৯ জন তাঁতিকে দেওয়া হয়েছে বিনা সুদে ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ। এ প্রকল্প পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন মণিপুরি তাঁতশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থীদের তৈরি কাপড়ও উন্মুক্তভাবে নিলাম করা হয়।

সম্প্রতি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি তিনটি তাঁতে মণিপুরি শাড়ি, ওড়না ও ফানেক (মণিপুরি নারীদের পরিধেয় বস্ত্র) কাপড় বুনছেন চারজন নারী। ওই দুজনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন প্রশিক্ষক কল্পনা দেবী। তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১২টি ব্যাচে মোট ৬০ জন তাঁতিকে এ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই ৬০ জনকে মণিপুরি শাড়িসহ অন্যান্য পোশাক তৈরি করতে হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণে সুতা চরকায় তোলা থেকে শুরু করে তাঁতে বুনে পুরো শাড়ি কাটা পর্যন্ত শেখানো হয়। তিনি বলেন, একটি শাড়ি তৈরি করতে দুজন তাঁতির প্রায় আড়াই থেকে তিন দিন সময় লাগে। একসময় নিজেও তাঁতি ছিলেন কল্পনা দেবী। শাড়িসহ অন্যান্য মণিপুরি কাপড় বুনতেন তিনি। তাঁর মতে, ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০০-০৪ পর্যন্ত মণিপুরি তাঁতিরা ভালো সময়ের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে বাজারজাতের অভাব এবং ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে যায় মণিপুরি তাঁতশিল্প। এরপর থেকে মণিপুরি তাঁতিরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। তিনি আরও বলেন, বাজারে চাহিদা থাকলেও মূলত মণিপুরি তাঁতিরা সরাসরি নিজেদের তৈরি পোশাক বাজারজাত করতে না পারায় পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আশাহত হয়ে পেশা বদলাচ্ছেন তাঁরা। মণিপুরিদের শাড়ি, চাদর, ওড়না, গামছা, বিছানার চাদর ও নকশিকাঁথার কদর বেশি। সে সঙ্গে মণিপুরি কাপড় দিয়ে তৈরি পোশকেরও কদর কম নয়। মণিপুরি নারীরাই এসব পোশাক তৈরি করেন।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার অঞ্জনা দেবী নামের এক তাঁতি জানান, কাজের ফাঁকে দুজন মিলে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে সময় দিয়ে একটি শাড়ি বুনতে তিন থেকে চার দিন সময় প্রয়োজন হয়। একটি শাড়ির সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক ৩০০-৩৫০ টাকা। চার দিনে দুইজনের পারিশ্রমিক বিবেচনায় এটি অত্যন্ত কম।

ধীরেন সিংহ বলেন, ‘মণিপুরিদের ঐতিহ্য পোশাকশিল্প বাঁচিয়ে রাখতে একধরনের সংগ্রাম চালাচ্ছি আমরা। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকগুলো মণিপুরি তাঁতিদের বিনা সুদে ও জামানতে পর্যাপ্ত ঋণের সুবিধা এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।’ তিনি জানান, বর্তমানে মণিপুরি তাঁতিরা এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় নকশা নকল করে কম মানের কাপড় বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে, যাতে মান হারাচ্ছে মণিপুরি তাঁতশিল্প। মণিপুরি তাঁতিদের এ পেশায় ফিরিয়ে আনতে ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মণিপুরি তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নকেন্দ্র, বিক্রয়কেন্দ্র নির্মাণসহ কয়েকটি প্রকল্প সরকারের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।