অস্ত্রোপচারের টেবিলে প্রসূতিকে ফেলে পালালেন ক্লিনিকের কর্মীরা

নারায়ণগঞ্জের এই ক্লিনিকে আজ দুপুরে অস্ত্রোপচারের টেবিলে মা–নবজাতককে ফেলে পালিয়ে যান চিকিৎসকসহ অন্যরা
ছবি: আসাদুজ্জামান

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান হতে পারে—এই শঙ্কায় সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মাকে অস্ত্রোপচারের টেবিলে রেখে বাইরে তালা দিয়ে পালিয়ে গেছেন ক্লিনিকের কর্মীরা। নারায়ণগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় আজ রোববার দুপুরে পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নামের একটি ক্লিনিকে এই ঘটনা ঘটেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) মাহমুদুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ওই মাকে উদ্ধার করেন। তারপর তাঁকে মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে মা ও নবজাতক ভালো আছে।

মাহমুদুর রহমান অ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধের চলমান অভিযানে তিনি শনির আখড়ায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন তাঁর কাছে খবর আসে, পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নামের ওই ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের টেবিলে মাকে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে সবাই পালিয়েছেন। তারপর ক্লিনিকটি খুঁজে পেতে বেশ সময় লাগে। তাঁরা যখন সেখানে পৌঁছান, তখন তালা খোলা পান। ভেতরে গিয়ে মাকে পান। এ সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা ভিড় করেন।

মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা পুরো সময় চাচ্ছিলাম, মা ও সন্তানের যাতে ক্ষতি না হয়। নিজে চিকিৎসক, তাই পৌঁছার পর মায়ের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করি। তখন তিনি ভালো ছিলেন। অস্ত্রোপচারের পর সেলাই দেওয়া হয়েছে। পোস্ট–অপারেটিভ কক্ষে না পাঠিয়ে টেবিলে ফেলেই সবাই পালিয়ে গেছেন। তখন থেকে ভাবছি, চিকিৎসকেরা কীভাবে পারলেন এভাবে অস্ত্রোপচারের রোগীকে ফেলে চলে যেতে? আমি তো ঘটনাটা বিশ্বাসই করতে পারছি না। অস্ত্রোপচার–পরবর্তী যেকোনো জটিলতায় মায়ের মৃত্যু হতে পারত।’

পরে বেলা দুইটার দিকে মা ও নবজাতককে মাতুয়াইলের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা। ওই নারীর স্বজনেরা বলেন, তাঁরা জানেন না, অস্ত্রোপচারের আগেই তাঁরা ক্লিনিকে ১০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন।

ওই ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
ছবি: আসাদুজ্জামান

মা ও নবজাতককে উদ্ধার অভিযানে ছিলেন ঢাকার সিভিল সার্জন আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল বন্ধ, সংস্কারের কাজ চলছে এমন কথা লেখা ছিল ক্লিনিকটির গেটে। এ লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল, অবৈধ ক্লিনিক বন্ধের অভিযানে যাওয়া কর্মকর্তাদের বোকা বানানো। তিনি জানান, এটি নিবন্ধিত কোনো ক্লিনিক নয়। এমনকি তারা কখনো অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে, তারও প্রমাণ নেই।

ক্লিনিকটিতে দুপুরে এ ঘটনার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নার্সসহ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা (আইসিইউ সুবিধা) থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেয় সন্তানসহ রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার জন্য। বেলা দেড়টার দিকে এই প্রতিবেদক যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর রুমে ছিলেন, তখনই পরিচালক অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত করা, কোন নার্স যাবেন, তা ঠিক করাসহ সার্বিক তদারকি করছিলেন।

পরে বিকেলের দিকে মুঠোফোনে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মা–সন্তানকে ঢাকা মেডিকেলে আর আনার প্রয়োজন হয়নি। তাদের মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে ভর্তি করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, এই মা ও নবজাতক ছাড়াও এই ক্লিনিকে গতকাল অস্ত্রোপচার করা তিনজন মা ছিলেন। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে পাঠানো হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর রাতে প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ওই ক্লিনিকে প্রসূতিদের চিকিৎসায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ চিকিৎসক ছিলেন না।

ঘটনার পর একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে রোগীর এক স্বজন বলেন, তাঁরা ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে যান। যাঁরা রোগী রেখে পালিয়েছেন, তাঁরা আসলেই চিকিৎসক বা নার্স কি না, তা নিয়েও এই স্বজন সন্দেহ পোষণ করেন। তাঁরা ১৮ হাজার টাকার চুক্তিতে ক্লিনিকটিতে অস্ত্রোপচার করে সন্তান প্রসবের জন্য মাকে ভর্তি করেছিলেন। এক সময় দেখলেন, তাঁরা ছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স কেউ নেই, সবাই পালিয়ে গেছেন।

পুলিশ দিয়ে ওই ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন।