আইন প্রয়োগে অনিশ্চয়তা কাটছে না

জরিমানা ছাড়া ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় বাড়ল আরও ছয় মাস। শিথিল করা শর্তে পেশাদার চালকের লাইসেন্স পাওয়া যাবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। পরিবহনমালিক–শ্রমিকদের এভাবে সুবিধা দেওয়ার কারণে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি কার্যকর করা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছেই না।

এর প্রভাব পড়েছে সড়কেও। লাইসেন্সবিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই।

আইনটি কার্যকরের আগের তুলনায় এখন ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে ৮১ হাজার। অন্যদিকে যানবাহনের তুলনায় এখনো লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ১২ লাখের মতো কম আছে; যা সড়ক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়।

বেসরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর সাত–আট হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। 

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে নতুন সড়ক পরিবহন আইন করে সরকার। কিন্তু আইনটি কার্যকর না করতে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামলে তা এক বছর ঝুলে থাকে। গত ১ নভেম্বর আইন কার্যকরের ঘোষণা দেওয়ার পর আবার আন্দোলনে নামেন মালিক–শ্রমিকেরা।

সুরাহার দায়িত্ব দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে। তিনি পরিবহনমালিক–শ্রমিকদের সঙ্গে দুদিন বৈঠক করেন। এরপর লাইসেন্স ও ফিটনেস–সংক্রান্ত অপরাধে মামলা না করার মৌখিক ঘোষণা দেওয়া হয়। আইনের আরও ১০–১২টি ধারা শিথিল করার দাবি করেন মালিক–শ্রমিকেরা। সেটাও বিবেচনার আশ্বাস দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 

এরপর বিআরটিএ ফিটনেস ও লাইসেন্স বিষয়ে শর্ত শিথিল করার ঘোষণা দেয়। গত জুনে এসব ঘোষণার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিআরটিএ তা আবার বাড়িয়ে দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন কোনো ঘোষণা না দিলেও এর ফলে সড়কে নতুন আইনের প্রয়োগ আবারও সীমিত হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার কড়াকড়িও করেছে। ওই সূত্র জানায়, পরিবহনমালিক–শ্রমিকদের খেপিয়ে সরকার আইনটি পুরোপুরি কার্যকর করতে প্রস্তুত নয়।

>যানহনের সংখ্যা এখন ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৫৮৮
যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা কম, ১২ লাখের মতো


এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, আইনের কিছু ধারা সংশোধনের দাবি আছে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের। এটা করতে হলে সংসদে তুলতে হবে। সরকার সাময়িক কিছু শিথিলতাও দেখিয়েছে। সব মিলিয়ে আরেকবার বসে সমাধানে আসতে হবে। কিন্তু করোনার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

দিনে দিনে বোঝা বাড়ছে

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ৬ জুলাই পর্যন্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৫৮৮টি। সড়ক আইন কার্যকরের আগে গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ছিল ৪ লাখ ৩ হাজার ৫৩৩টি। অর্থাৎ আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়ার পর ফিটনেসবিহীন যানবাহন বেড়েছে ৮১ হাজার ৫৫টি।

গত নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে বৈঠকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ফিটনেসবিহীন যানের বিরুদ্ধে জুন পর্যন্ত মামলা দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে বিআরটিএ এক বছর পর্যন্ত ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই, এমন যানের জরিমানা মওকুফ করে দেয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিআরটিএ জরিমানা ছাড়া ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময়সীমা আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে। 

অন্যদিকে ৩০ জুন পর্যন্ত স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ২৭ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪৯টি। এর বাইরে আরও লাখ পাঁচেক লাইসেন্স প্রিন্ট হওয়ার অপেক্ষায় আছে। অর্থাৎ লাইসেন্স কার্ড এবং লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য চালক আছেন সাকল্যে সাড়ে ৩২ লাখের কিছু বেশি। অবশ্য এসব চালকের কারও কারও একাধিক লাইসেন্সও আছে।

বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে ৪৪ লাখ ৭১ হাজার। যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স কম আছে ১২ লাখের মতো। 

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জরিমানা ছাড়া ফিটনেস সনদ নেওয়া এবং লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। এখন রাস্তায় মামলা হবে কি না, সেটা তাঁরা বলতে পারবেন না। তবে আইন প্রয়োগ না হওয়ার কোনো কারণ তিনি দেখছেন না।

দীর্ঘদিনের জঞ্জাল জমেছে

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আড়াই লাখের কাছাকাছি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ডেলিভারি ভ্যান রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশিই উচ্চতা,
লম্বা ও চওড়া কয়েক ফুট পর্যন্ত পরিবর্ধন করা হয়েছে। একইভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই যাত্রীবাহী বাসের আসন ৫ থেকে ১০টি পর্যন্ত বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে বিআরটিএ থেকে এসব যানের ফিটনেস দেওয়া হয়েছে। এত দিন গাড়ি না দেখেই ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে। 

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর কড়াকড়ি আরোপ করে বিআরটিএ। এখন উচ্চতা, লম্বা ও চওড়া মাপা হয়। ফলে এসব যানের মালিকেরা ফিটনেস সনদ নিতে যান না। আগে আকৃতি পরিবর্তন, ফিটনেস সনদ না থাকার দায়ে জরিমানা ছিল সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। এ জন্য পরিবহনমালিকেরা গুরুত্ব দিতেন না।

নতুন আইনে যানবাহনের আকৃতি পরিবর্তনের দায়ে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড, তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ফিটনেসবিহীন যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। 

ফলে বিপুলসংখ্যক যানবাহনের প্রকৃত আকৃতি ফিরিয়ে আনা কঠিন ব্যাপার। আবার এগুলোকে বৈধ করতে হলে আইন পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা আইনত এগুলোর ফিটনেস সনদ পাওয়ার সুযোগ নেই।

 আইনের প্রয়োগ কতটা

নভেম্বরের আগে পুলিশ গড়ে মাসে সাড়ে তিন লাখ মামলা দিত। জরিমানা আদায় করত ১৬ লাখ টাকার মতো। আইন কার্যকরের পর মামলা নেমে আসে ৩৫ হাজারে। ডিসেম্বরে–জানুয়ারিতে পুলিশ নতুন আইনের প্রয়োগ কঠোর করা শুরু করে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আবার আটকে দেয়। 

একইভাবে বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেটরা আইন কার্যকরের আগে গড়ে দিনে এক লাখ টাকা জরিমানা করতেন। পরে তা ২০–২৫ হাজারে নেমে আসে। বর্তমানে বিআরটিএর সাতটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ঢাকায় গড়ে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। তা–ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার দায়েই বেশি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে যে আইনটা আমরা পেলাম, সেটা শুরু থেকেই হোঁচট খেল। পরিবহনমালিক–শ্রমিকদের চাপে সরকার আইনটির প্রয়োগই করতে পারল না।’