আইন ভাঙার প্রহর

আইন ভাঙার প্ল্যানে এমন একটা অতর্কিত ভাব ছিল যে অনেকে ভালো করে বুঝতে পারল না কী করতে হবে।

এমএ পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে। ঢাকায় আসি ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর কি ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে।

প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন সাহেব যেদিন ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, তার পরের দিনই পুরোনো আর্টস বিল্ডিংয়ের আমতলায় তড়িঘড়ি একটা সভা করে সেই ঘোষণার আমরা নিন্দা করি। মনের রাগে ও দুঃখে সেদিন আমি বলেছিলাম, ‘শুনেছি ফ্যাসিস্ট ইতালিতে স্লোগান দেওয়া হতো—মুসোলিনি কোনো দিন ভুল করে না। দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে অনুরূপভাবে আমাদের ওপর একটা সবক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে জিন্নাহর কথাই অভ্রান্ত। তার নড়চড় হবে না।’

জিন্নাহ সাহেবকে কায়েদে আজম হিসেবে উল্লেখ না করায় দু–একজন ছাত্র মারমুখো হয়ে প্রতিবাদ করে ওঠে। কিন্তু আমার গায়ে কেউ হাত তোলেনি সেদিন। সে সময়ে ছাত্রদের মধ্যে মতানৈক্যের জন্য হাতাহাতির কোনো নজির ছিল না। কোনো রাজনৈতিক নেতার উল্লেখ করার সময় তাঁর পিতৃদত্ত নাম উচ্চারণ করাই আমার কাছে বরাবর সমীচীন মনে হয়েছে।

শিগগিরই ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন ঘটল। ২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। কী রকম একটা বিপৎসংকেতের মতো শোনাচ্ছিল সরকারি গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ পরিবেশনটি। যখন শুনলাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। মনে হয়েছিল, আমাদের আন্দোলনকে কারা যেন বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাত ৯টা-১০টার সময় আমরা সাত-আটজন বন্ধুবান্ধব মিলিত হই ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে। যত দূর মনে পড়ে, সেখানে মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ,
গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন। অনেক পরে শুনেছি যে ওই বৈঠকে একজন গুপ্তচরও উপস্থিত ছিলেন। আমি এখন তাঁর চেহারা মনে করতে পারছি না।

ওই সভায় একটা প্রশ্ন ওঠে, বিনা প্রস্তুতিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে অযথা শক্তিক্ষয় করা হবে কি না। মুসলমান ছাত্রসমাজে আইন ভাঙার তেমন রেওয়াজ ছিল না বললেই চলে। কলকাতায় রশিদ আলী দিবস, ভিয়েতনাম দিবস ও আরও অন্যান্য আন্দোলনের সময় আমি ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ অমান্য করতে দেখেছিলাম। সেদিন রাতে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে এবং আন্দোলন বন্ধ করা চলবে না। আমরা কেমন করে আইন অমান্য করব, তার কোনো স্পষ্ট ছবি তখন আমাদের মনে ছিল না। তরুণ মনে এই আশা ছিল যে একবার ১৪৪ ধারা ভাঙলে বেশির ভাগ ছাত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য।

পরদিন সকালে আমি আর মোহাম্মদ সুলতান জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি স্কুলে গেলাম ধর্মঘট কেমন চলছে দেখার জন্য। নবাবপুরে আওয়ামী লীগের অফিসে একবার ঢুঁ মেরে দেখলাম, ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত হবে কি না, এ নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। শহরে তখন একটা উত্তেজনার ভাব। আর্টস বিল্ডিংয়ে ফিরে এসে দেখি, মিটিং শুরু হয়েছে। গাজীউল হক দুহাত তুলে সভা পরিচালনার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি শামসুল হক সাহেব নিজের অনেক কথা বলে ১৪৪ দারা ভঙ্গের বিরোধিতা করলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কনভেনার আবদুল মতিন সাহেব অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে প্ল্যান দিলেন যে একসঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে পারে। সুতরাং ১০ জন ১০ জন করে ছোট ছোট দল এগিয়ে যাবে ১৪৪ দারা ভাঙার জন্য। গাজীউল হক সেই প্ল্যানকে সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করলেন। উত্তেজনায় জমায়েত ফেটে পড়ল। ভাইস চ্যান্সেলর মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব সবাইকে একবার শান্ত করার চেষ্টা করলেন।

আইন ভাঙার প্ল্যানে এমন একটা অতর্কিত ভাব ছিল যে অনেকে ভালো করে বুঝতে পারল না কী করতে হবে। আগের রাতে যাঁদের মধ্যে আইন ভাঙার ব্যাপারে একটু ইতস্তত ভাব ছিল, দেখলাম, তাঁদের সেই দোটানা ভাব কখন কেটে গেছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছাড়বে বলে অনেকে রুমাল ভিজিয়ে নিল। ভিড়ের মধ্যে আমিও আমার রুমালটা ভিজিয়ে নিলাম। তার জন্য মনে কেমন যেন একটা লজ্জা হচ্ছিল। প্রক্টরের গেটের কাছে ক্রমশ ভিড় জমছে, কিন্তু রাস্তায় বের হওয়ার কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। চতুর্দিকে একটা বিশৃঙ্খলার ভাব। কেউ কারও কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখলাম, আমাদের আগের দিনের প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাবার জোগাড়। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমরা কয়েকজন যদি গেটের বাইরে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙি, তবে কেমন হয়। আমাকে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে, এমন কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে নেই। আমি যেহেতু আগের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙার ওপর জোর দিই, সে জন্য বন্ধুদের একটা প্রত্যাশা ছিল যে আমি প্রথমে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে যাব।

যাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে এলেন, মোহাম্মদ সুলতান তাঁদের নাম লিখে দিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘তুই আমার পঙ্খিরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ গলা ফাটিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম কয়েকজনকে সঙ্গে করে। তখন বেলা সোয়া একটা। উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের ভাপ বেরোচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার এক ধারে ঘেরাও করে রাখে।

আর্টস বিল্ডিংয়ের ওপর দিকে একঝলক তাকিয়ে দেখলাম, আমার দু–একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দোতলা থেকে আমাদের লক্ষ করছেন। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্য ছাত্ররা গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করল, তখন আমাদের কয়েকজনকে পুলিশ একটা ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা যখন তেজগাঁওয়ের দিকে চলতে শুরু করল, তখন মনের অবস্থা হালকা করার জন্য আমি বললাম, ‘দূরে কোথাও কোনো মজাপুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলা হবে।’

ট্রাকটা চলার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় মানসিক উত্তেজনা কিছু কমল, কিন্তু দুর্ভাবনা বাড়তে থাকল। অবশেষে আমাদের তেজগাঁও পুলিশ স্টেশনে হাজির করা হলো। ছোট্ট একটা হাজতঘরে আমাদের ১০–১২ জনকে একসঙ্গে আটকে রাখা হলো। হাজতঘরে আরও দু-একজন আসামি ছিল। ঘরে প্রস্রাবের গন্ধে টিকতে না পেরে আমরা চেঁচামেচি করি। পরে আমাদের বড় একটি খোলা ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। রাত্রে দারোগা সাহেবের অফিস ঘরে মাটিতে শোবার জন্য ঢালাও বন্দোবস্ত করা হলো। পোড়া খিচুড়ি খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ রাত তিনটায় ঘুম ভাঙল। ফিসফিস করে কানাকানি করছে সবাই। শুনলাম, ঢাকায় গুলি চলছে। ধীরে ধীরে কথাটা প্রত্যেকের কানে পৌঁছাল। অল্প শক্তির একটি ঘোলাটে বিজলিবাতির আলোয় বড় ঘরটার আবহাওয়া ক্রমেই ভারী হয়ে উঠল। সকালে আমাদের পুলিশ ভ্যানে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। রাস্তা একবারে জনশূন্য। সব খাঁ খাঁ করছে। পুলিশ আর সেনাবাহিনী চারধার ঘিরে রেখেছে। জনতার মধ্য থেকে কেউ কেউ আমাদের জন্য কিছু খাবার এনে দিলেন। বন্ধুদের পরামর্শে অবাঙালি পুলিশ ও সৈন্যদের উদ্দেশে উর্দুতে কয়েক মিনিট বক্তৃতা করার চেষ্টা করলাম। কয়েকখানা মর্নিং নিউজ পত্রিকাও পোড়ানো হলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোর্টে হাজির না করেই আমাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেওয়া হলো।

পরে শুনলাম, খুনের চেষ্টা, মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রসহকারে দাঙ্গা, কর্তব্যরত সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগে আমাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিচারাধীন কয়েদির নম্বর ৪৭৭ হলো আমার পরিচয়। বেশ কয়েক দিন পর জেলের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে আমাদের হাজির করা হলো। আমরা এই বলে সাফাই দিলাম যে, ‘১৪৪ ধারা অন্যায়ভাবে জারি করা হয়, সেই ভেবে আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি।’ যত দূর মনে পড়ছে, আমি ১১ মার্চ জেল থেকে বেরিয়ে আসি।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা (১৯৯৬)

ভেসে গেল কালস্রোতে, মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ (উপদেষ্টা সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ, সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০৮) গ্রন্থ থেকে