আইনজীবী রাশেদুলের অন্যরকম লড়াই
রাশেদুল আলম চৌধুরীর দুই হাতের গঠন স্বাভাবিক নয়। তিনি প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে ১৫ বছর পার করেছেন আইন পেশায়।
দুই হাত সুগঠিত নয়। হাতের কবজি কনুইয়ের কাছাকাছি, তা-ও আবার বাঁকানো।
এমন হাত দিয়ে মামলার আরজি লেখা, ফাইলপত্র বহনসহ সব কাজই করেন চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী রাশেদুল আলম চৌধুরী।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ় মনোবলের জোরে প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে নিজেকে আইন পেশায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন রাশেদুল।
১৫ বছর ধরে সক্রিয়ভাবে আইন পেশার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর এ লড়াই দেখে মুগ্ধ আইনজীবী ও মক্কেলরা। তাঁরা বলছেন, রাশেদুল অসম্ভবকে সম্ভব করে চলছেন।
রাশেদুল চট্টগ্রামের আইনজীবী। গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবী ভবনে গিয়ে দেখা যায়, তিনি নিজের কক্ষে বসে মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছেন, পাশাপাশি কাগজে সাবলীলভাবে নোট নিচ্ছেন। একপর্যায়ে মক্কেলের কাছ থেকে যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে মামলার আরজি লিখতে শুরু করেন তিনি।
ব্যস্ততার ফাঁকে কথা হয় রাশেদুল ও তাঁর কাছে আসা মক্কেলদের সঙ্গে। মামলার প্রয়োজনে রাশেদুলের চেম্বারে নগরের দেওয়ানবাজার এলাকা থেকে এসেছিলেন জামাল উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে জানান, অন্য আইনজীবীদের চেয়ে রাশেদুল কোনো অংশে কম নন। তাঁর কাজকর্ম দেখে মনে হয় না, তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী।
একই বক্তব্য রাশেদুলের সহকারী রাশেদ হামিদেরও।
রাশেদুল জন্মগতভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বাভাবিক শিশুদের মতো লেখার চর্চা করেছেন। কাজটা কঠিন হলেও দ্রুত তা রপ্ত করে ফেলেন তিনি।
সব বাধা ডিঙিয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন রাশেদুল। এরপর আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন। ২০০৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বারে আইন পেশায় যুক্ত হন।
সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রাশেদুল তৃতীয়। জন্মগতভাবে দুই হাত স্বাভাবিক না থাকলেও রাশেদুলকে তা বুঝতে দেননি মা ফারুকুন নাহার। তিনি তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়ে রাশেদুলের প্রতি একটু বাড়তি মনোযোগ দেন। মায়ের প্রেরণায় রাশেদুল তাঁর প্রতিবন্ধিতা জয় করে অগ্রসর হতে থাকেন। আজকের অবস্থানে আসার পেছনে তাই মায়ের অবদানকেই বড় করে দেখেন রাশেদুল।
ফারুকুন নাহার প্রথম আলোকে জানান, তাঁর ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এটি যে তিনি দেখে যেতে পারছেন, এটাই তাঁর কাছে বড় পাওয়া।
প্রতিবন্ধীদের অবহেলা না করে তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পরিবার, স্বজনসহ সবার প্রতি আহ্বান জানান ফারুকুন নাহার। তিনি জানান, প্রতিবন্ধীরা যাতে পরিবার ও সমাজের বোঝা না হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তাঁরাও যাতে পরিবার-সমাজকে কিছু দিতে পারেন, সে জন্য সবার এগিয়ে আসা উচিত।
রাশেদুলের স্ত্রী আয়শা ইসলাম জানান, তাঁর স্বামী সব কাজ করতে পারেন। তিনি নিজের জামাকাপড় পরা, জিনিসপত্র নেওয়াসহ সবই করেন। পাশাপাশি তিনি সাংসারিক কাজেও তাঁকে সাহায্য করেন।
চট্টগ্রামের একাধিক আইনজীবী জানান, আদালতপাড়ার তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে শারীরিকভাবে সক্ষম অনেক আইনজীবীকেও হাল ছেড়ে দিতে দেখা যায়, কিন্তু রাশেদুল অদম্য। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে সফল আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যাচ্ছেন। দুই হাতে মামলার ফাইল নিয়ে তিনি এক আদালত থেকে আরেক আদালতে ছুটে যান। আদালতের ভেতরেও তিনি সমান সক্রিয়। তিনি সবার জন্য প্রেরণা।
রাশেদুল প্রথম আলোকে জানান, ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল থাকলে যেকোনো বাধা ডিঙিয়ে সফল হওয়া যায়। তার জন্য প্রয়োজন পরিশ্রম ও সাধনা। যে কারণে দুই হাতের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি সব কাজ করে যেতে পারছেন।
আইন পেশাকে কেন বেছে নিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদুল বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হওয়ার মাঝে একধরনের তৃপ্তিবোধ আছে। আইন পেশায় চ্যালেঞ্জ আছে। তাই এ পেশা বেছে নিয়েছি।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এনামুল হক প্রথম আলোকে জানান, রাশেদুল নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আর দশজনের মতো নিজের কাজ সমানে করেন, যা সবার জন্য দৃষ্টান্ত।