আইনি ভিত্তি দেওয়া যায় কি না, ভাবছে সরকার, আজ বৈঠক

হাফ পাশ নেই—লেখা মুছে দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা
প্রথম আলো

নিরাপদ সড়কের জন্য ২০১৮ সালে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া নিশ্চিতের দাবিও ছিল। তবে সরকার বিষয়টি তখন আমলে নেয়নি। এবার শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দাবিতে আন্দোলনে নামার পর বিষয়টিকে আইনি ভিত্তি দেওয়া যায় কি না, সেটি ভাবছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

সরকারি এই সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার প্রচলনের শুরু পাকিস্তান আমলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মুখে মুখে এই নিয়ম চালু আছে। বিষয়টি সেভাবে মানা হয় না।

অন্যদিকে পরিবহনমালিকেরা বলছেন, আইনে না থাকায় অর্ধেক ভাড়া নিয়ে বাসে প্রায়ই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহনশ্রমিকদের তর্ক-ঝামেলা হয়। এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার এ নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা।

এমন পরিস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে সরকারের তিন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বৈঠকে বসছেন। এতে সড়ক পরিবহন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ছাড়াও পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, হাইওয়ে পুলিশ এবং বিআরটিএর কর্মকর্তা থাকবেন। ডাকা হয়েছে পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতাদেরও।

গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দাবি নিয়ে সরকার ও বিআরটিএ কাজ করছে। সব পক্ষের মতামত নিয়ে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হবে
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন সময় মন্ত্রীদেরও ঘোষণা ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের রীতি এবং মন্ত্রীদের ঘোষণা আইনে পরিণত করা বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তা বৈধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণে যে ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়, এতে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে মাঠে নামার পর করণীয় ঠিক করতে বিআরটিএ একটি কমিটি করেছে। এর প্রধান করা হয়েছে সংস্থার পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানীকে। কমিটি পুরোনো দলিল যাচাই করে, পরিবহনমালিকদের সঙ্গে কথা বলে অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোনো আইন, নির্বাহী আদেশ বা বিধিমালা আছে কি না, তা খুঁজে দেখছে। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ–সংক্রান্ত কোনো নথি তারা পায়নি। জেলা প্রশাসকের দপ্তরে এ–সংক্রান্ত কোনো দলিল বা নথি আছে কি না, তা জানতে বিআরটিএ থেকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তবে এরই মধ্যে সরকারের কেউ কেউ এবং সরকারপন্থী পরিবহনমালিকদের অনেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ষড়যন্ত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সরকারবিরোধীরা মদদ দিচ্ছে বলেও মনে করেন তাঁরা।

ফাইল ছবি

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, বেসরকারি পরিবহনমালিকেরা কখনোই সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া নেন না। এমনকি বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে বাসের আকৃতি পরিবর্তন করে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করছেন। লক্কড়–ঝক্কড় বাস দিয়ে নতুন বাসের ভাড়া আদায় করছেন। অথচ শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবির বিষয়ে তাঁরা আইনের দোহাই দিচ্ছেন। আইন মানলে সব ক্ষেত্রেই মানা উচিত। তাঁরা বলছেন, পরিবহন খাতে মালিক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন সমিতি-সংগঠনের নামে যে চাঁদাবাজি হয়, সেটি বন্ধ হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিয়েও ভালো ব্যবসা সম্ভব।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দাবি নিয়ে সরকার ও বিআরটিএ কাজ করছে। সব পক্ষের মতামত নিয়ে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

বাসে অর্ধেক ভাড়া যেভাবে এল

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ তাদের ১১ দফায় গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার দাবি তুলেছিল। ১১ দফার ১(ঢ)-তে উল্লেখ ছিল ‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের “আইডেনটিটি কার্ড” দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ “কন্সেসনে” টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও “কন্সেসন” দিতে হইবে।

১১ দফার ১ (ঢ)-তে আরও উল্লেখ ছিল, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যেকোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ “কন্সেসন” দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে।’

তখনকার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, তখন তাঁদের আন্দোলনের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়। এই ধারা স্বাধীনতার পরও বহু বছর চালু ছিল।

২০১৫ সালের অক্টোবরে বিআরটিসির কার্যালয়ে বাস ডিপো ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এক বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, রাজধানীতে চলাচলরত বিআরটিসির পাশাপাশি অন্যান্য পরিবহনেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেবে। আর না নিলে দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

১৯৪০ সালের মোটরযান বিধিমালায় বলা হয়েছে, অনূর্ধ্ব ১২ বছর বয়স্ক শিশুকে অর্ধেক হিসেবে গণনা করতে হবে। অনূর্ধ্ব তিন বছরের শিশুকে হিসাবের মধ্যে রাখা অর্থাৎ গণনা করা যাবে না। বিধিমালাটি এখনো কার্যকর আছে।

বিআরটিএর আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সংস্থাটির সাবেক কর্মকর্তা আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি বৈধ। শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে একটা নির্দেশনার কথা শোনা যায়। কিন্তু এর দলিল কোথায় আছে, তা কেউ বলতে পারছে না।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। একটি বাসে সর্বোচ্চ কতজন শিক্ষার্থী উঠতে পারবে, অর্ধেক ভাড়া শুধু স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য, নাকি সবার জন্য প্রযোজ্য হবে—এটা ঠিক করা জটিল বিষয়। শিক্ষার্থীদের পোশাক এবং আইডি কার্ড থাকতে হবে কি না, এগুলোও সামনে এসেছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর উল্লেখ করে একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থী ও পরিবহনমালিক—এই দুইয়ের মাঝে কাউকে বিরাগভাজন করতে চাইছে না সরকার।

এই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁরা সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তবে সরকার নিশ্চয় পরিবহনমালিকদের লোকসানে ফেলবে না।

রেলে শিক্ষার্থীদের জন্য কী ব্যবস্থা

সরকারের গণপরিবহন সংস্থা হচ্ছে রেলওয়ে ও বিআরটিসি। রেলে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার বিধান আছে। নিয়মটি হচ্ছে, নির্ধারিত ফরমে শিক্ষার্থীকে নিজ প্রতিষ্ঠান প্রধানের সই নিয়ে জমা দিলে অর্ধেক ভাড়ায় ভ্রমণ করতে পারবে। তবে এ নিয়ম শুধু মেইল, এক্সপ্রেস, লোকাল ও কমিউটার ট্রেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ছবি: বাংলাদেশ রেলওয়ে

রেলের আরেকটি বিধান হচ্ছে, ৩ থেকে ১২ বছর বয়সীরা অপ্রাপ্তবয়স্ক টিকিট পাবে। এ ক্ষেত্রে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে ৬৬ শতাংশ। তিন বছরের কম বয়সীদের টিকিট লাগবে না। এই বিধান সব ট্রেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

গণপরিবহন যেমন হওয়ার কথা

সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, বাসে আসন থাকবে ৫২টি, মিনিবাসে ৩০টি। দুটি আসনের হেলান দেওয়া স্থানের দূরত্ব হবে ২৬ ইঞ্চি। কিন্তু পরিবহনমালিকেরা ইচ্ছেমতো বাসে আসন বসিয়েছেন। ফলে যাত্রীরা পা সোজা করে বসতে পারেন না।

রাজধানীতে ‘সিটিং’ বাস সার্ভিসের নামে দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হয় । আর ‘লোকাল’ বাসে পা ফেলার জায়গা থাকে না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহনমালিকেরা কোনো আইনই মানে না। শুধু শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাসের’ বেলায় আইন খোঁজে। তিনি সরকার ও পরিবহনমালিকদের সমালোচনা করে বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হলে, পরিবহনে শৃঙ্খলা এলে প্রতিটি বাসে ৫-৭ জন শিক্ষার্থীকে অর্ধেক ভাড়ায় বহন করলেও মালিকদের কোনো লস হবে না। তিনি বলেন, সরকার নিজের দায়িত্ব পালন করছে না। আর পরিবহনমালিকেরা চলছেন নিজের ইচ্ছায়।