আইল ধলের মেলা

পরমেশ্বরী দেবীর মন্দির ঘিরে প্রতি ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার যে ধলমেলা হয়, একবার সেই মেলা চলাকালে মন্দিরের ঠিক পেছনেই জটলা বেঁধে সবুজ ঘাসের ওপর বসেছিলাম আমরা। সূর্যের আলো তখন ডুবুডুবু। রণেশ ঠাকুর, শাহ নূরজালালসহ আরও কয়েকজন ছিলেন। বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করেই কয়েকজন পুলিশ এসে বেধড়ক পিটুনি দিল আমাদের। নূরজালাল ভাইয়ের হাতে-পায়ে লাঠির কয়েকটি বাড়ি পড়ে, কিছুটা আহত হয়েছিলেন রণেশদাও, আমার পিঠেও পড়ে গোটা দুয়েক লাঠির আঘাত। আচমকা এমন হামলায় হতবিহ্বল নূরজালাল ভাই মুহূর্তেই রুখে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে অন্যরাও প্রতিবাদমুখর হলেন। পুলিশ তাদের ভুল বুঝতে পারল। তারা ভেবেছিল, মেলার অন্য আরও কয়েকটি স্থানের মতো এখানেও জুয়াড়িরা জুয়া খেলা বসিয়েছে। তাই তাদের এমন আকস্মিক চড়াও হওয়া!

পুলিশের পেটা খেয়ে বিমর্ষবদনে ফিরে এলাম আমরা। ঘটনার রেশ তখনো মন থেকে সরেনি। শাহ আবদুল করিমের বাড়ির সংগীতালয়টিতে বসে বসে ঘটনার কারণ জিজ্ঞাসু উজানধল গ্রামের একে-ওকে তখনকার মুহূর্ত আর পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করছিলাম। এমুখ-ওমুখ হয়ে বিষয়টি আবদুল করিমেরও কানে পৌঁছায়। খবর পেয়ে সাতাশি পেরোনো করিম সংগীতালয়ে ছুটে এলেন। বললেন, 'আমার রণেশ রে বুঝি পুলিশে পিটাইছে!' আমি থ বনে গেলাম। যেখানে তাঁর নিজের ছেলে নূরজালালই আহত, সেখানে প্রথমেই উচ্চারণ করলেন রণেশদার নাম। শিষ্যের প্রতি কী গভীর ভালোবাসা আর অপত্য স্নেহ! আমার বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। তাকালাম আবদুল করিমের দিকে। কুপিবাতির আলোয় আবছা আবছা দেখি, তাঁর চোখ চিকচিক করছে। জানি, এ পানি কেবল রণেশদার জন্য। না নূরজালাল ভাইয়ের জন্য, না অন্য কারও জন্য।

বাউলশিল্পী রণেশ ঠাকুরকে নিয়ে এসব কথা আমি লিখেছি লোকসাধকের দরবারে (২০১৯) বইয়ে। ধলমেলার প্রসঙ্গ উঠলেই আমার সেদিনের পুলিশি–পেটা আর প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের চোখের চিকচিক পানির দৃশ্যই মূলত মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে, ঝিমধরা এক অন্ধকার রাতে কয়েক শ মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ধলমেলার পাশে কালনী নদীর তীরে বাউলশিল্পী বিল্লাল উদাস গাইছেন তাঁর মুর্শিদ আবদুল করিমের গান, 'পয়লা ফাল্গুনে আইল ধলের মেলা/ যাও যদি আও দলে দলে উঠেছে বেলা ॥// এই করিমের পয়সা নাই রসগোল্লা খাই না খাই/ রস বিলাইতে আমি যাই ওগো সরলা॥'

ধলমেলার একাল-সেকাল
প্রায় আড়াই দশক আগে প্রথমবার ধলমেলায় গিয়েছিলাম আমি। তখন সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। এরপর আরও অন্তত ছয় থেকে সাতবার যাওয়া হয়েছে। তবে সময় যত গড়িয়েছে, চার শ বছরের পুরোনো ধলমেলা হারিয়েছে ঐতিহ্য। আশির দশকেও যেখানে কয়েক লাখ মানুষের সমাগত হতো, এখন সেখানে পঞ্চাশ হাজার মানুষ হয় কি না সন্দেহ। এই বদলে যাওয়াকে 'প্রযুক্তির কুফল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন পরমেশ্বরী মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দুলন চৌধুরী। এ কমিটিই মূলত ধলমেলার আয়োজন করে থাকে। দুলন জানান, একটা সময়ে গ্রামাঞ্চলে বিনোদনের সবচেয়ে বড় উপলক্ষ ছিল বান্নি অর্থাৎ মেলা। এ কারণেই প্রতিবছরের মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে হাওরাঞ্চলে কয়েক শ মেলা হতো। এখনো হয়। এখন প্রযুক্তির কারণে বিনোদনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। তবে গ্রামীণ মানুষের কাছে আবেগ আর ভালোবাসায় ধলমেলা এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এ সময়ে প্রতি বাড়িতেই নাইওরি আসেন।

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে আবদুল করিমের গ্রাম উজানধলের পাশ দিয়ে প্রবহমান কালনী নদীর তীরবর্তী পরমেশ্বরী মন্দিরে দেবীরূপী 'তিন থেকে চারটি শিলাকে' ঘিরে প্রতি ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার ধলমেলা অনুষ্ঠিত হয়। যদিও আগের দিন মঙ্গলবার বেল-কুইশ্যাইলের (ইক্ষু) মেলা হয়। আবার দ্বিতীয় বুধবারেও পৃথকভাবে 'মেয়েলোকের মেলা' বসে। হাওরাঞ্চলের কৃষকদের একমাত্র বোরো ফসল যেন খরা কিংবা অকালবন্যায় বিনষ্ট না হয়, সে জন্য হিন্দুধর্মাবলম্বীরা নির্দিষ্ট তিথি-ক্ষণে পরমেশ্বরীর শিলাকে পূজা করতেন। সেই পূজার সূত্র ধরেই ধলমেলার উৎপত্তি। ধর্মীয় মেলা হলেও শেষ পর্যন্ত এটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরমেশ্বরীর পূজা ঘিরে যে মেলা হয়, সেটা হাওরাঞ্চলের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদেরও মিলনমেলায় পরিণত হয়। মন্দির ঘিরে একদিকে মহা–উৎসাহে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কীর্তন-লুট আর মানতের পাঁঠা বলিদান পর্ব চলে, অন্যদিকে হাজারো দোকানে চলে বিকিকিনি।

সুনামগঞ্জের ধলমেলায় চলছে কেনাকাটা। এই মেলাটিই পরিপুষ্ট করেছিল বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিমকে।
ছবি: দুলন চৌধুরীর সৌজন্যে

ধলমেলা যে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার কাছে মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে, এর বড় উদাহরণ বাউলসাধক আবদুল করিমের রচিত পুস্তিকা ধলমেলা (১৯৯০)। করিমের আত্মার আত্মীয় এই ধলমেলা। বলা যেতে পারে, এই প্রাচীন মেলার আনন্দগীতের মধ্যেই তিনি পরিপুষ্ট হয়েছেন। তাই ধলমেলাকে তিনি অভিহিত করেছেন 'আনন্দমেলা' আর 'তীর্থমেলা' বলে। কবে থেকে মেলার উৎপত্তি, তা করিমের জানা না থাকলেও তাঁর দেখা ৫০ বছর আগের মেলার সঙ্গে এই সাধক শেষজীবনে যে মেলা দেখেছেন, তার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য করিম প্রণীত পুস্তিকায় অনেকটা ঐতিহাসিকের বর্ণনার মতোই উঠে এসেছে। তার মানে, ১৯৪০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল করিমের ধলমেলা পুস্তিকার বিষয়বস্তু। করিম তখনই হতাশা প্রকাশ করেছিলেন, 'ওরে মেলা দিতে জ্বালা কার মন্ত্রণা পাইলে/ এই দেশে কেন বা তুমি আইলে ॥//মেলা তোরে করি মানা এই বেশে তুই আর আসিস না/ গরিবরে দুঃখ দিস না আবদুল করিম বলে'। সে হিসাবে ৩১ বছর পর ২০২১ সালে ধলমেলার বর্তমান অবস্থা কোন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে, সেটা সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়।

আবদুল করিম ধলমেলা পুস্তিকায় জানিয়েছিলেন, 'নদীপথে যোগাযোগ ছিল পরিষ্কার/ কালনী নদী দিয়া তখন চলত ইস্টিমার।/ ঢাকা হতে সার্কাস দল আসিত নৌকায়/ যোগদান করিত এই আনন্দ মেলায়।/ হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক সঙ্গে নিয়া আইত/ মেলাতে ঘর বাঁধিয়া খেলা দেখাইত।' মুর্শিদের এ বর্ণনার সূত্র ধরে উজানধল গ্রামেরই বাসিন্দা রণেশ ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, 'আমার জন্ম ১৯৬০ সালে। বয়স যখন বারো অথবা তেরো, তখনো সার্কাস দলকে মেলায় আসতে দেখেছি। এরপর ধীরে ধীরে নদীতে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। সার্কাস দলের আসার পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে।' তিনি আরও জানিয়েছিলেন, একটা সময়ে ধলমেলায় অনুষ্ঠিত যাত্রাগান মানুষজন টিকিট কেটে দেখতেন। পরে বেশি মুনাফা লাভের আশায় আয়োজনকারীরা যাত্রার পাশাপাশি অশ্লীল নৃত্যও চালু করে দেয়। এ অবস্থায় আশির দশকের দিকে যাত্রাগানের আয়োজন বন্ধ হয়ে পড়ে। আগের মতো বাউলগান কিংবা পুতুলনাচও হয় না। তবে কয়েক বছর ধরে জুয়াখেলা বন্ধ আছে।

সুনামগঞ্জের ধলমেলার একাংশ
ছবি: দুলন চৌধুরীর সৌজন্যে

ধলমেলায় সেসব সামগ্রীই পাওয়া যায়, যেসব সামগ্রী সচরাচর পাওয়া যায় অন্যান্য গ্রামীণ মেলায়ও। যেমন দা, কুড়াল, ছেনি, খন্তি, কাঁচি, কোদাল, কোচা, ডেগ, ঘটি, বাটি, কলস, জালের কাঠি, লাঙলের ফাল, বাঁশের ছাতা, চাটি, পাটি, পলো, মাটির তৈরি সামগ্রী, ছানার মিষ্টি, চিড়া, মুড়ি, দধি-দুগ্ধ, তেল, সাবান, চুলের কাঁটা, চিরুনি, টিপ, গলার মালা, হাতের বালা, চুড়ি, পাউডার, নেলপালিশ, লিপস্টিক, কসমেটিকস, জুতা, কাপড়, শিশুদের খেলনা, অ্যালুমিনিয়ামের বাসন ইত্যাদি। আগের মতো মেলার পরিসর হয়তো এখন আর নেই, তবে এসব সামগ্রী ঠিকই কিনতে পাওয়া যায়। অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও ধলমেলায় অতিবিখ্যাত বেল-ইক্ষু ঠিকই এখনো মেলায় পাওয়া যায়। বলা দরকার, এসব কিনতে মানুষের ভিড় থাকে বেশি। দিনে দিনে ধলমেলার পরিসর ছোট হয়ে পড়ার বিষয়ে করিম লিখেছেন, 'ব্রিটিশ আমলে মেলার পূর্ণরূপ ছিল/ দেশ বিভক্ত হয়ে যখন পাকিস্তান এল।/ ধনী-মানী-জ্ঞানী-গুণী হিন্দু ছিল যারা/ ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল তারা।' মূলত এরপর থেকেই আস্তে আস্তে ধলমেলা বিবর্ণ হতে থাকে। আর অন্ত্যমিলে লেখা করিমের এ বয়ান থেকে এটি বোঝা যাচ্ছে যে ধলমেলাটি ব্রিটিশ আমলে যথেষ্ট রূপ-যৌবনবতী ছিল।

বিদায়ে বিষাদ
রণেশ ঠাকুর, নূরজালাল ও আমাকে ধলমেলায় যে বছর পুলিশ পিটিয়েছিল, সেটা ছিল ২০০৪ সাল। ওই রাতে আবদুল করিমের বাড়িতেই নিশি পার করেছিলাম আমি। করিম যে বিছানায় শুতেন, এর ঠিক পাশে ছিল আরেকটি খাট। সেখানেই আমি শুয়েছিলাম। বিদ্যুৎহীন সে ঘরে জ্বলছিল হারিকেনের মৃদু আলো। আধো আলো আধো অন্ধকারে চোখে পড়ে, করিমের দেখাশোনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী নূরুন্নেসা হাতপাখা দিয়ে করিমকে বাতাস করছেন। রাত জেগে আসরে আসরে গান গেয়ে বেড়ানো বহুকালের নিশাচর করিমের চোখে যেমন ঘুম নেই, তেমনই অজানা কারণে ঘুম নেই আমারও। বারবার বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে গড়াগড়ি করি। শব্দ পেয়েই সম্ভবত করিম বলেন, 'ও বেটি নূরুন্নেসা, মেহমান বেটা ঘুমাইছইননি? তার লাগি মেলা থাকি বাবুলে (শাহ নূরজালালের ডাকনাম) কুনতা আনছেনি?' নূরুন্নেসা উত্তরে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন।

পরদিন বিকেলে আবদুল করিমের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে গন্তব্য ফিরে আসার প্রস্তুতি নিই। তখনই করিম হাতে তুলে দেন একটি সাবান। মেলায় বাড়িতে আসা অতিথি বিদায়ের সময়ে এটাই রীতি। আগের সন্ধ্যায় মেলা থেকে নূরজালাল বেশ কিছু সাবান কিনেছিলেন। তারই একটি শাহ করিম তুলে দিলেন আমার হাতে।

নাইওরি বা স্বজনের হাতে মেলা থেকে কেনা উপহারসামগ্রী তুলে দেওয়ার চার শ বছরের ঐতিহ্য আর রীতির পরম্পরাই যেনবা তিনি প্রবহমান রাখলেন! মাসখানেক ব্যবহারের পর উপহারের সাবান ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সাবানের সেই প্যাকেট আমার কাছে এখনো রয়ে গেছে। পরমেশ্বরী দেবী, ধলমেলা, কালনী নদী কিংবা শাহ আবদুল করিম—সবকিছুকেই একসূত্রে গেঁথে রেখেছে ট্রাঙ্কের ভেতরে সযত্নে পড়ে থাকা সাবানহীন একটি শূন্য প্যাকেট।