আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশ রোহিঙ্গাদের একমাত্র সান্ত্বনা

২৩ অক্টোবরের মধ্যে গাম্বিয়া পূর্ণ আরজি পেশ করবে। মিয়ানমার জবাব দেবে আগামী বছরের জুলাইয়ে।

নাগরিকত্বসহ সাত দফা দাবি পূরণ হলেই নিজ দেশে ফিরে যাবে রোহিঙ্গারা।
ফাইল ছবি

অব্যাহত জাতিগত নিপীড়ন ও নির্যাতনের মুখে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেশান্তরিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্নমুখী কূটনৈতিক উদ্যোগ ও তৎপরতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরানোর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। তবে এই সময়ে রোহিঙ্গাদের জন্য একমাত্র আশা জাগানোর ঘটনা যেটি ঘটেছে, তা হলো মিয়ানমারে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের ওপর সম্ভাব্য গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে তাদের সুরক্ষা দিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) নির্দেশ।

সেখানে গণহত্যার অপরাধ ঘটেছে কি না, সে বিষয়েও আইসিজে পূর্ণাঙ্গ শুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ চাপের মধ্যে ফেলেছে। আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গণহত্যার ঝুঁকি থেকে রক্ষায় অন্তর্বর্তী একটি আদেশ দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হলে গত ডিসেম্বরে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে সেই আবেদনের ওপর শুনানি হয়।

আদালত অন্তর্বর্তী আদেশ জারির পর গণহত্যার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, সে বিষয়েও শুনানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং গাম্বিয়াকে তার পূর্ণাঙ্গ আরজি পেশ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। আগামী ২৩ অক্টোবরের মধ্যে গাম্বিয়াকে গণহত্যা মামলার পূর্ণ আরজি পেশ করতে বলা হয়েছে এবং মিয়ানমারকে তার জবাব দিতে হবে ২০২১ সালের ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে। এ ছাড়া আলাদাভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট—আইসিসি) মিয়ানমারের সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক তদন্ত করছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় গণহত্যা সনদ লঙ্ঘন থেকে নিবৃত্ত রাখা ও গণহত্যার অপরাধের সব সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আইসিজে গত ২৩ জানুয়ারি আদেশ জারি করেন। আইসিজের ওই আদেশ প্রতিপালনে দেশটি কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তার প্রথম প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার জন্য আদালত ২২ মে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এরপর প্রতি ছয় মাস পরপর আদালতকে অগ্রগতি জানানোরও আদেশ রয়েছে। মিয়ানমার আদালতের রায় অনুসরণ করে নির্ধারিত সময়েই প্রথম প্রতিবেদনটি দিয়েছে বলে জানিয়েছে। মিয়ানমার আইসিজের শুনানিতে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছিল এবং অন্তর্বর্তী আদেশ জারির মতো কোনো পরিস্থিতি নেই বলে দাবি করলেও এখন আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিল।

এই প্রতিবেদনে কী আছে, তা আইসিজে যেমন প্রকাশ করেনি, তেমনই মিয়ানমার বা আদালতে মামলাকারী দেশ গাম্বিয়া—কেউই প্রকাশ করেনি। অবশ্য চলমান কোভিড–১৯ মহামারির কারণে আইসিজের কার্যক্রম কয়েক মাস বন্ধ ছিল এবং বর্তমানে তা সীমিত আকারে চলছে।

এদিকে মিয়ানমার সরকার আইসিজেতে তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার মাস দেড়েক আগে গত ৮ এপ্রিল জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ মেনে চলা এবং রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সব সহিংসতার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা জারি করে। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) তরফ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে তখন বলা হয়েছিল যে দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক নেতা অং সান সু চি আদালতকে বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে এবং এনএলডি সরকার সেগুলো উপেক্ষা করবে না।

দেশটির মন্ত্রী, রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন, সামরিক ও বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা–কর্মচারীরা যাতে গণহত্যা সনদের বিধি ২ ও ৩ লঙ্ঘন না করেন, তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টের জারি করা আদেশে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাক্ষ্যপ্রমাণ ধ্বংস করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের মতো কোনো অপরাধের চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও প্রেসিডেন্টের দপ্তরকে জানানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সংগঠকেরা অবশ্য মিয়ানমারের এই বিবৃতির কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই বলে একাধিকবার মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সেনাবাহিনী ও এনএলডি সরকারের এসব নির্দেশনা মূলত আন্তর্জাতিক আদালতের মামলাগুলো মোকাবিলার কৌশলমাত্র। বাস্তবে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতেও রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি অব্যাহত থাকার খবর পাওয়া গেছে।

আগামী নভেম্বরে দেশটিতে যে পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে, তাতে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে আশাবাদ তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। রোহিঙ্গা নেতা খ মিন ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস পার্টি নামের একটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ১৮ আগস্ট তা বাতিল হয়ে গেছে। খ মিন ১৯৯০ সালে এমপি নির্বাচিত হলেও ২০১৫ সালের মতো এবারও তাঁর মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দিয়েছে। মা–বাবার নাগরিকত্বের প্রমাণ না থাকায় তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

কূটনৈতিক পরিসরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানকে নিন্দা জানানো, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ পর্যন্ত অন্তত তিনবার প্রস্তাব গ্রহণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতাই এর প্রধান কারণ। এ ছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামেও চীন, রাশিয়ার পাশাপাশি ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অনেকেই বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি। কূটনৈতিক পরিসরে এই হতাশাজনক অচলাবস্থার মধ্যে রোহিঙ্গাদের শেষ ভরসা আন্তর্জাতিক আদালত।

আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে যে গাম্বিয়া, তার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশকে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ নিপীড়ন ও বঞ্চনার অবসানের পথে একটি ছোট পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই রায় এক দিনে রোহিঙ্গাদের জীবন বদলে দেবে না। তবে এটি একটি প্রক্রিয়ার সূচনা। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির এই অপেক্ষার পালাও কম দীর্ঘ হবে না। কেননা, আইসিজেতে বিভিন্ন মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক বছর সময় লাগে।