আওয়ামী লীগের স্বস্তি-অস্বস্তি

জাহিদ মালেক ও মফিজুল ইসলাম খাঁন
জাহিদ মালেক ও মফিজুল ইসলাম খাঁন

উচ্চ আদালতের আদেশে মানিকগঞ্জ–৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খানের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ আটকে যাওয়ায় প্রথমে স্বস্তিতে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। তবে এই আসনে বিএনপির সমর্থকদের ভোটের হিসাব নিয়ে তাঁরা এখন অস্বস্তিতে।

মানিকগঞ্জ পৌরসভা, সাটুরিয়া উপজেলা এবং জেলা সদরের সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ–৩ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭০৭। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৭ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৭০ জন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ মালেক।বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকায় এখন এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি মফিজুল ইসলাম খান। তিনি নির্বাচন করছেন উদীয়মান সূর্য প্রতীক নিয়ে। আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ধারণা, নির্বাচনে বিএনপি না থাকলেও এই দলের সমর্থকদের ভোটগুলো এখন উদীয়মান সূর্য প্রতীকেই পড়বে।

ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটি একসময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত টানা চারটি সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী জয়লাভ করেন। ২০০৮–এর নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হারুনার রশিদকে হারিয়ে দেন আওয়ামী লীগের জাহিদ মালেক। সর্বশেষ ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

এই আসনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬৩ হাজার ৯৬৩ ভোট, সপ্তমে ৬৪ হাজার ৭১৫ ভোট, অষ্টমে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৪ ভোট ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ২১৬ ভোট।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কর্মী–সমর্থকদের ভাষ্য, গত এক দশকে এই নির্বাচনী এলাকায় প্রতিমন্ত্রী যত অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন তাতে তাঁর জয়ের ব্যাপারে তাঁরা আত্মবিশ্বাসী। এলাকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নেও মন্ত্রীর ব্যাপক ভূমিকা আছে। কিন্তু বিএনপির নির্দিষ্ট ভোটগুলো উদীয়মান সূর্য প্রতীকে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ‘মাঠে বিএনপি না থাকায় আমাদের কিছুটা সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে গণফোরামের প্রার্থী থাকায় আমরা খুব নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি না। তাই বিএনপির ভোটগুলো কীভাবে নৌকায় তুলে আনা যায়, সে ব্যাপারে আমরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এ জন্য প্রচার–প্রচারণা কিংবা গণসংযোগে কোনো ঘাটতি রাখা হচ্ছে না।’

এই আসনে গণফোরামের প্রার্থী মফিজুল ইসলাম খান ১৯৭৩ সালে একবার আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদেও ছিলেন। ১৯৯৩ সালে তিনি গণফোরামে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি দলটির নির্বাহী সভাপতির দায়িত্বে আছেন। এলাকার শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন, বিশেষ করে নারীশিক্ষা প্রসারে তাঁর অবদান রয়েছে।

গতকাল রোববার মফিজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় শহরের খান বাহাদুর আওলাদ হোসেন খান ডিগ্রি কলেজ রোডসংলগ্ন বাসভবনে। নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘নির্বাচনে সবার দাবি ছিল একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে, সবাই সমান সুযোগ পাবে। কিন্তু আমরা সেটা পাচ্ছি না। প্রচার–প্রচারণার ক্ষেত্রে পদে পদে আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।’ এ সময় তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে তাঁর নির্বাচনী পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা ও তাঁর বাসভবনের সামনে দফায় দফায় ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগ আনেন। 

মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে আমার বাড়ির সামনে প্রথম দফায় ককটেল মারার পর সদর থানা আমার অভিযোগ নেয়নি। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি। এরপরও আমার বাড়ির সামনে আরও কয়েকবার ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।’ তাঁর দাবি, একজন সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহিদ মালেক প্রচার–প্রচারণায় সব ধরনের সুযোগ নিচ্ছেন। তাঁর উন্নয়নকাজের ফিরিস্তি তুলে ধরতে ঢাকা থেকে সরকারি কর্মকর্তারা আসছেন।

এসব বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য গতকাল সন্ধ্যায় জাহিদ মালেকের মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে পরিচয় দিয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুরের পর তিনি মানিকগঞ্জ–২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মমতাজ বেগমের পক্ষে সদর উপজেলার হাটিপাড়া ইউনিয়নে প্রচারণা চালান।

অবশ্য প্রচারণায় বাধা দেওয়া ও ককটেল নিক্ষেপের অভিযোগ আনা গণফোরামের প্রার্থীর বক্তব্যের জবাবে মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা মনে করি, উনি (মফিজুল ইসলাম) ইচ্ছে করেই এই ধরনের কাণ্ড করে আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন, যাতে অন্যদের মনোযোগ পাওয়া যায়।’

এদিকে এই আসনে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী জহিরুল আলম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে। ক্ষমতাসীন দলের ‘কতিপয় উৎসাহী নেতা–কর্মীর’ বিরুদ্ধে তিনিও তাঁর প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনেন। ২০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সময়ে যদি এলাকায় উন্নয়ন হয়ে থাকে তবে নির্বাচন নিয়ে ভয় কেন? আওয়ামী লীগের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হোক, তা তারা চায় না।’