আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগে গুরুত্বারোপ

কোভিডপরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব নিয়ে আয়োজন।

কোভিডপরবর্তী বিশ্বে ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক কারণে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে পরাশক্তিগুলোর আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাই এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির স্বার্থে সংযুক্তির অবকাঠামোতে অর্থায়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতায় বিশেষ জোর দিতে হবে।

কোভিডপরবর্তী বিশ্বে বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত এক ওয়েবিনারে বক্তারা এ মন্তব্য করেন। ‘কোভিড-১৯–পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধমান, রাজনৈতিক, প্রতিবেশগত ও আঞ্চলিক গুরুত্ব’ শীর্ষক ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইএমআরএডি-বিমরাড) এবং আইইউবির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) যৌথভাবে ওই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।

আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার।

বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় বাংলাদেশে ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টেরিঙ্ক বলেন, অবকাঠামো ও সংযুক্তি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে অন্য অংশীদারদের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইইউ এরই মধ্যে এশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা নিয়ে একটি কৌশলপত্র ঠিক করেছে। যেখানে পরিবহনব্যবস্থা ও জ্বালানি বাণিজ্যের পাশাপাশি জনগণের অবাধ চলাচলের বিষয়গুলোকে রাখা হয়েছে। এ অঞ্চলের সঙ্গে সহযোগিতার অংশ হিসেবে নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে উৎপাদনের পর তা বিতরণে সঞ্চালন লাইনে অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আঞ্চলিক সঞ্চালন কাঠামো তৈরি নিয়ে কাজ চলছে। সার্ক থমকে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে উন্নয়নের জন্য বিমসটেককে কেন্দ্র করে ইইউ কাজ করতে আগ্রহী।

প্যানেল আলোচক নেপালের প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রামেসোর খানাল বলেন, এ অঞ্চলের সমৃদ্ধির জন্য বঙ্গোপসাগরকে শান্তিপূর্ণ রাখা অপরিহার্য। কারণ শুধু বাণিজ্য নয়, ভূরাজনৈতিক কারণে পরাশক্তিগুলোর কাছে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি বাড়ছে উপকূলীয় জাহাজ চলাচলের গুরুত্বও। এর সঙ্গে রয়েছে এ অঞ্চলে অভিন্ন জ্বালানি বাজার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও। এসব বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগের বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে।

প্যানেল আলোচক বিমরাডের উপদেষ্টা কাজী সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর থেকে একদিকে আমাদের মিয়ানমারের পশ্চিমাংশ, অন্যদিকে চীনের ইউনান পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ কিংবা সুবিধাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তাতে নজর দিতে হবে। কাজেই বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সংযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।’

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস বলেন, সাগরবেষ্টিত বাংলাদেশ ও ভারত চাইলেই দূরের দেশের সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে পারে। যে সুবিধা ভূবেষ্টিত নেপাল ও ভুটানের জন্য অনেক বেশি সীমিত। তাই আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমেই উন্নতি বা সমৃদ্ধি সম্ভব। এ জন্য দরকার সমন্বিত আঞ্চলিক পদক্ষেপ।

মাশফি বিনতে শামসের মতে, আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর স্বার্থে রাজনৈতিক সহনশীল সীমান্ত পরিস্থিতি জরুরি। তিনি বলেন, সংযুক্তির ক্ষেত্রে যখন বহুমাত্রিক পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তখন সেখানে জনগণের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে ভিসা প্রক্রিয়া শিথিল করার বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে।

সমাপনী বক্তৃতায় আইইউবির বে অব বেঙ্গল ইনস্টিটিউট প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো ও সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম বলেন, ‘কোভিডপরবর্তী বিশ্ব একেবারেই আলাদা। সেখানে ভূরাজনীতি, অর্থনীতি কোনো কিছুই আর আগের নিয়মে থাকছে না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই চার পর্বের ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। আলোচনায় আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে। কেননা আমাদের একের অস্তিত্ব অন্যের ওপর নির্ভরশীল। একে অন্যের সাফল্য থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সেটা ভুটানে কোভিডে কোনো মৃত্যু না হওয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ৮ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি যেটাই হোক না কেন। তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে যদি দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তা পুরো অঞ্চলের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। কাজেই ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় বিশেষ জোর দিতে হবে।’

স্বাগত বক্তৃতায় আইইউবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মিলান পাগন বলেন, ‘এসব আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব আমরা আবার বুঝতে পেরেছি। আলোচনায় যেসব পরামর্শ ও মতামত পেয়েছি, তার ভিত্তিতে আমরা অগ্রসর হতে পারি।’

ওয়েবিনারে আরও বক্তৃতা দেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী, বাংলাদেশে ভুটানের সাবেক রাষ্ট্রদূত সোনাম তোবদেন রাবগি, বিমরাডের মহাপরিচালক কমোডর কাজী ইমদাদুল হক এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সের পরিচালক সব্যসাচী দত্ত।