আট মাসে ৫৪০ কোটি টাকা ক্ষতি বেবিচকের

করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে ধুঁকছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পথে ফ্লাইট ও যাত্রীসংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমার প্রভাব পড়েছে তাদের আয়ে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৫৪০ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে সংস্থাটি।

বেবিচক সূত্র বলছে, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে আকাশপথ সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। বহু বিমান সংস্থাকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হয়েছে। যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ফ্লাইটের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেকের নিচে নেমেছে। এ অবস্থায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল খাতও সংকটে পড়েছে।

বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা ফিরে যাচ্ছেন। এ কারণে ফ্লাইট ও যাত্রী সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে তা করোনার আগের মতো অবস্থায় ফেরার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত নেই। আগে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ২৮ বিমান সংস্থা বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করত। বর্তমানে ১৮টি সংস্থা কার্যক্রমে ফিরেছে।
মফিদুর রহমান, বেবিচকের চেয়ারম্যান

জানতে চাইলে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষায় বিভিন্ন সুবিধা দিতে হচ্ছে। তাদের লাইসেন্স নবায়ন ফিতে ছাড় দিতে হয়েছে। যাত্রীবাহী ফ্লাইটে বদলে তাদের কার্গো ফ্লাইট, চার্টার্ড ফ্লাইট ও বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যাতে করে দেশীয় বিমান সংস্থাগুলো আয় করতে পারে। এ ছাড়া তাদের আর্থিক সুবিধা দিতে একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এসব সুবিধা দিতে গিয়ে বেবিচকের রাজস্ব আয় আরও কমতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।

বেবিচকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মিলে আকাশপথের যাত্রী সংখ্যা ছিল ১ এক কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার জন। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পথে প্রতিদিন প্রায় দেড় শ ফ্লাইট চলাচল করেছে। ওই বছর আন্তর্জাতিক পথের যাত্রী ছিল প্রায় ৮৫ লাখ ৯৬ হাজার; অভ্যন্তরীণ পথে ৪৪ লাখ ৮২ হাজার। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক পথে যাত্রী ছিল ৮২ লাখ ৬৪ হাজার; অভ্যন্তরীণ পথে ছিল ৪১ লাখ ২৫ হাজার। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে মোট যাত্রী বেড়েছিল ৭ লাখ।

কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে যাত্রীসংখ্যা উল্টো কমতে থাকে। স্বাভাবিক সময়ে শুধু হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েই প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার যাত্রী চলাচল করেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যাত্রী সংখ্যা ১০হাজারের নিচে নেমে আসে। ফ্লাইট সংখ্যাও অর্ধেকের নিচে নেমে যায়। মার্চ মাসে চীন ও যুক্তরাজ্য ছাড়া সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মে মাস থেকে যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত বেবিচকের প্রতিদিন গড়ে আয় কমে যায় ৩৫ লাখ টাকার মতো। জুন মাস থেকে সীমিত পরিসরে ফ্লাইট চলাচল শুরু হওয়া আয়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে থাকে। তবে তা আগের মতো স্বাভাবিক হওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই।

বেবিচক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের আয়ের খাত বহুমুখী। এর মধ্যে রয়েছে উড়োজাহাজ পার্কিং, অ্যারোনটিক্যাল, নন অ্যারোনটিক্যাল চার্জ, ওভার ফ্লাইং চার্জ, যাত্রী ফি, দেশি বিমান সংস্থাগুলোর লাইসেন্স নবায়ন ফি, কার পার্কিং, দর্শনার্থী টিকিট বিক্রি ও বিমানবন্দরে দোকান ভাড়া। এসব খাত থেকে বেবিচক ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সব মিলিয়ে আয় করে করেছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এই আয় থেকে কর্মীদের বেতন, রানওয়েসহ বিমানবন্দরগুলোর অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটানো হয়। সব খরচ মিটিয়েও বড় অঙ্কের টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু কিন্তু করোনার কারণে এবার তার পরিবর্তে উল্টো ক্ষতির মুখে আছে সংস্থাটি।

  • ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮০০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল।

  • চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

  • কিন্তু এই আট মাসে আয় হয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকার মতো।

কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেবিচক যে রাজস্ব আয় করেছিল, সব খরচ বাদ দিয়েও ৮০০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বেবিচক ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। কিন্তু এই আট মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৫০০ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৫৪০ কোটি টাকা।

চলতি বছরের শেষ চার মাসেও আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন না বেবিচকের চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা ফিরে যাচ্ছেন। এ কারণে ফ্লাইট ও যাত্রী সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে তা করোনার আগের মতো অবস্থায় ফেরার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত নেই। আগে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ২৮ বিমান সংস্থা বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করত। বর্তমানে ১৮টি সংস্থা কার্যক্রমে ফিরেছে। তাও সীমিত পরিসরে ফ্লাইট চলছে। আগের তুলনায় যাত্রী চলাচল করছে মাত্র ৪০ শতাংশ। চলতি বছরের বাকি সময়টাতেও ফ্লাইট ও যাত্রী কোনোটিই বাড়বে না বলেই মনে হচ্ছে। তাই আয় বৃদ্ধির জন্য বেবিচককে আরও অপেক্ষা করতে হবে।