আতিথেয়তায় উৎসবে সমাদৃত বগুড়ার দই

বগুড়ার দইছবি: প্রথম আলো

চৈত্রের ভরদুপুর। খরতাপের দহনে পুড়ছে মাঠঘাট, পুড়ছে প্রকৃতি। নীলাকাশ যেন নীরব হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। ভ্যাপসা গরম, মাঝেমধ্যে লু হাওয়া। গাছের তলে শুকনো ঝরাপাতা ঝুরঝুর শব্দে উড়ছে, উড়ছে ধূলিঝড়। তপ্ত রোদে পুড়ে ফসলের মাঠে খেতে কাজ করা কৃষক গান ধরেন, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই।’ ধূলিমাখা মেঠো পথ ধরে মহল্লায় আসে দইওয়ালার হাঁকডাক ‘দই চাই দই, ভালো দই।’

চল্লিশের দশকের ছেলেবেলায় চৈত্রের এক দুপুরে একজন দইওয়ালার এ হাঁকডাকের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের সংলাপ মিলে যেতে পারে। অনেকের স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে পারে দইওয়ালার হাঁকডাক ঘিরে শৈশব স্মৃতি। দই শুধু বিশ্বকবির মন জয় করেনি, বিখ্যাত রম্যলেখক শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পেও দুই ভাই হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধনের দইপ্রীতির কথা উঠে এসেছে।

কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শ্রীমতী ক্যাফে ও বিপিনের সংসার উপন্যাসেও রসনাপ্রিয় খাদ্য হিসেবে দই খোলস ছড়ায়। তারাশঙ্করের গল্পেও ঘুরেফিরে দইয়ের কীর্তির কথা এসেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর গল্প–উপন্যাসে দইয়ের মতো বিলাসী খাবার বাঙালির পাতে দেওয়ার ব্যাপারে উদারতা দেখাননি।

শুধু সাহিত্যে নয়, বাস্তবেও প্রাচীনকাল থেকেই আবহমান বাংলায় বিভিন্ন আচার–অনুষ্ঠান ও সামাজিক ভোজে দই পরিবেশন করা হচ্ছে। বাঙালি সমাজে দুগ্ধজাত নানা ধরনের খাবারের মধ্যে গুণেমানে দই অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে আজও বিবেচনা করা হয়। অধুনা কোনো প্রীতিভোজে খাবার শেষে দই না থাকলে বড্ড বেমানান লাগে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের সেই দইওয়ালার মতো ভাঁড়ে করে দই-ক্ষীরশা বিক্রি করার দিন পাল্টেছে। এখন শহরের সুসজ্জিত শোরুমে সুস্বাদু দইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন দইওয়ালারা। ক্রেতারা সেই দই কিনতে সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়েন।

দেশের সব জেলাতেই দই তৈরি হলেও স্বাদে-মানে ও অনন্যতায় ‘বগুড়ার দই’–এর খ্যাতি এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে। উৎসব-আতিথেয়তায় বগুড়ার দই সর্বত্র সমাদৃত।

কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের শ্রীমতী ক্যাফে ও বিপিনের সংসার উপন্যাসেও রসনাপ্রিয় খাদ্য হিসেবে দই খোলস ছড়ায়। তারাশঙ্করের গল্পেও ঘুরেফিরে দইয়ের কীর্তির কথা এসেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য তাঁর গল্প–উপন্যাসে দইয়ের মতো বিলাসী খাবার বাঙালির পাতে দেওয়ার ব্যাপারে উদারতা দেখাননি।

বগুড়ার শতাধিক দোকানে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ দই বেচাকেনা হয়। দইকে ঘিরে মাটির সরা ও হাঁড়ি তৈরি হয় প্রতিদিন। সেই হিসেবে বছরে কয়েক শ কোটি টাকার দইয়ের বাজার তৈরি হয়েছে।

বগুড়ার দই নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও যত দূর জানা যায়, গেল শতাব্দীতে শেরপুরের হিন্দু ঘোষ সম্প্রদায়ের কারিগরদের হাত ধরে বগুড়ায় দইয়ের প্রচলন হয়। ঘোষ সম্প্রদায় ছোট ছোট হাঁড়িতে টক দই ভরে তা ভাঁড়ে করে শহরে এনে বিক্রি করতেন। পোড়া মাটির ছোট ছোট ডুঙ্গিতে দই ভরানো হতো। এর ওপর ননিযুক্ত আবছা জাফরান রং থাকত। রাজাবাজার ও ফতেহ আলী বাজারেও এই ঘোষেরা রাস্তার পাশে দইয়ের ভাঁড় নিয়ে বসতেন।

শেরপুরের ঘোষপাড়ার গৌর গোপাল পাল নামের একজন দইওয়ালা টক দই সরবরাহ করতেন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নওয়াব পরিবারের কাছে। সেই দই নবাবদের অন্য রকম কদর ও প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তখন গৌর গোপালের এই দই খ্যাতি পেয়েছিল ‘নওয়াববাড়ির দই’ নামে। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথকেও বগুড়ার দই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল বলে জানা যায়।

পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বগুড়ার দই তৈরিতে হিন্দু ঘোষদের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন মুসলিম কারিগরেরাও। তখন গৌর গোপালের পাশাপাশি মহরম আলীর দই এবং বাঘোপাড়ার রফাত-এর দইয়ের সুনামও ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

শেরপুরের ঘোষপাড়ার গৌর গোপাল পাল নামের একজন দইওয়ালা টক দই সরবরাহ করতেন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নওয়াব পরিবারের কাছে। সেই দই নবাবদের অন্য রকম কদর ও প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তখন গৌর গোপালের এই দই খ্যাতি পেয়েছিল ‘নওয়াববাড়ির দই’ নামে। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথকেও বগুড়ার দই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল বলে জানা যায়।

দই ব্যবসায়ীদের তথ্য অনুযায়ী, আশির দশকে বগুড়া শহরে সুসজ্জিত শোরুমে সরা ও হাঁড়ি সাজিয়ে দই বিক্রি ও বাজারজাতকরণে আধুনিকতা ও অভিনবত্ব আনে দই ঘর নামের একটি প্রতিষ্ঠান। স্বাদে ভিন্নতা এনে বগুড়ার দইকে ক্রেতাদের কাছে উপস্থাপন করে এশিয়া সুইটস।

বর্তমানে বগুড়া শহর ও শহরতলির শতাধিক হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও শোরুমে বগুড়ার দই বিক্রি হচ্ছে। স্বাদ ও মান বিবেচনায় প্রসিদ্ধ দই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেরপুরের সাউদিয়া, ফুডভিলেজ, জলযোগ, বৈকালী, শুভ ও সম্পা দধি ভান্ডার, পল্লী দই, বগুড়ার এশিয়া সুইটস, দই ঘর, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, শ্যামলী হোটেল, সেলিম হোটেল, মহররম আলীর দই, গৌর গোপালের দই, রফাতের দই, চিনিপাতা দই, কোয়ালিটি সুইটসের দই ব্যাপক সমাদৃত ক্রেতাদের কাছে।

এ পর্যন্ত বগুড়ার দই যাত্রা করেছে নেপাল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, ভারতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, বালুরঘাট আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাসহ নানা উৎসবে। সেখানে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে বগুড়ার দই। এ ছাড়া প্রবাসী ও বিদেশি পর্যটকদের হাত ধরে প্রতিদিনই বগুড়ার দই যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

বগুড়ার দইয়ের কীর্তির কথা বলতে গিয়ে একটা কথা এসে গেল কলমে,

‘বাঙালির বড় প্রিয় মাছে আর ভাতে

ভালো হয় শেষে যদি দই পড়ে পাতে।।

একবার রসনায় যে পেয়েছে তার

আর কিছু মুখে নাহি ভালো লাগে তাঁর।।

যে কখনো এইসব করেনি গ্রহণ

বৃথাই জীবন তার, বৃথাই যাপন।।’


●বজলুল করিম বাহার কবি, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার