‘আনন্দের বাজারে’ এসে টাকা খোয়ালেন গ্রাহকেরা

নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা।

ই-কমার্সের নামে এবার গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে ‘আনন্দের বাজার’ নামের আরেকটি কোম্পানি। এর কার্যালয় গুলশানের জব্বার টাওয়ারের ১৩ তলায়। এক মাস ধরে গ্রাহকদের কাছে পণ্য সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল কোম্পানিটি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সামাজিক মাধ্যমে কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রাহকদের অনেকে সেখানে ভিড় করেন। তবে তাঁদের শেষ পর্যন্ত হতাশা নিয়েই বাসায় ফিরতে হয়েছে। কোম্পানির কার্যালয় তালাবদ্ধ ছিল।

গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে ব্যবসা শুরু করে আনন্দের বাজার। নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ ছাড়ের প্রলোভন দেখিয়ে মোটরসাইকেল, মুঠোফোনসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করত তারা। শুরুতে ৩০ কর্মদিবসের মধ্য কিছু গ্রাহকের কাছে পণ্য সরবরাহ করে আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালায় কোম্পানিটি। এই ফাঁদে পড়েন অন্য গ্রাহকেরা। এক মাস ধরে পণ্যের জন্য টাকা নিলেও প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে তা সরবরাহ করছিল না তারা।

একটি মোটরসাইকেল এবং ৮০টি মুঠোফোন কেনার জন্য আনন্দের বাজারে চাহিদা (অর্ডার) দিয়েছিলেন আফসার উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী। এ জন্য দেড় মাস আগে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকাও জমা দেন। কিন্তু সময়মতো পণ্য না পেয়ে তিনি কোম্পানির কার্যালয়ে এসে গত মাসে যোগাযোগ করেন। এর পর থেকে তাঁকে ঘোরাচ্ছিলেন কোম্পানির কর্মকর্তারা। শেষে তাঁকে একটি চেক দেওয়া হয়। কিন্তু সেই চেক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

* গুলশানে কোম্পানির কার্যালয় তালাবদ্ধ। কোম্পানির কর্মকর্তাদের খুঁজে পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। * কার্যালয়ের এক মাসের ভাড়া বাকি রেখে সরিয়ে ফেলা হয়েছে কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ আসবাব। * কত গ্রাহক প্রতারিত, কত টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, তদন্তের পর জানা যাবে, বলছে পুলিশ।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক দফায় আনন্দের বাজারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আহমুদুল হক খন্দকারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হয়, তাতেও সাড়া দেননি তিনি। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো উত্তর দেননি তিনি।

জব্বার টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, গত সোমবারও ওই অফিস খোলা ছিল। গতকাল অফিসে কেউ আসেনি। অফিসের জিনিসপত্র কখন সরানো হয়েছে, তা দেখেননি তিনি।

পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল সকালে আনন্দের বাজারের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একজন গ্রাহক প্রতারণার অভিযোগে মামলা করতে আসেন। ওই গ্রাহক পুলিশকে জানান, কার্যালয় বন্ধ করে কোম্পানির লোকজন পালিয়ে গেছে। এরপর দুপুরে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বজলুর রশিদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল জব্বার টাওয়ারে আসে। সেখানে তখন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক ছিলেন। তাঁদের কয়েকজনের বক্তব্য শোনার পর পুলিশ আনন্দের বাজারের কার্যালয়ের তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। দেখা যায়, মেঝেতে কিছু কাগজ ও ফাইল পড়ে ছিল। প্রায় ৫০টির মতো কম্পিউটার টেবিল ও চেয়ার থাকলেও কোনো কম্পিউটার ছিল না। অন্য আসবাবও সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

এসআই বজলুর রশিদ জানান, এই কোম্পানির কত গ্রাহক, কত টাকার ব্যবসা, কত গ্রাহকের টাকা আটকে আছে, মামলার পর তদন্তে তা জানা যাবে। তবে গত রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত আনন্দের বাজারের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি।

গতকাল বিকেলে জব্বার টাওয়ারে আনন্দের বাজার কার্যালয়ের সামনে কথা হয় কোম্পানির গ্রাহক এম এ হোসাইনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ শতাংশ ছাড়ে গত ১৮ আগস্ট ৮ লাখ ৮ হাজার টাকায় তিনটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন। গত মাসের ২৬ তারিখে মোটরসাইকেলগুলো পাওয়ার কথা ছিল। পরে তিনি যোগাযোগ করলে চেক দেওয়া হয়। কিন্তু দু-তিনটি ব্যাংকে ঘুরেও টাকা তুলতে পারেননি। কারণ, যে হিসাবের বিপরীতে চেক দেওয়া হয়েছিল, সেই হিসাবে কোনো টাকা নেই।

পুলিশ সূত্র জানায়, তিন মাস আগে মাসে ৫ লাখ টাকা ভাড়ায় জব্বার টাওয়ারের ১৩ তলায় অফিস নিয়েছিল আনন্দের বাজার। গত মাসের ভাড়াও দেয়নি তারা।

জব্বার টাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল সকালে জানতে পারেন, ওই কোম্পানি অফিস বন্ধ করে চলে গেছে। মালিক আহমুদুল হক খন্দকারের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। বিষয়টি তাঁরাও পুলিশকে জানিয়েছেন।

সম্প্রতি একের পর এক ই-কমার্স কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আসছে। এর মধ্যে ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, নিরাপদডটকম, কিউকম ও এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকের পাওনা না দেওয়া অর্থ পাচারের অভিযোগও উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, ওই ৬ কোম্পানি অন্তত ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এই ৬টিসহ মোট ১২টি ই-কমার্স কোম্পানি গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারীদের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না।

ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতারণার মামলায় ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেল ও তাঁর স্ত্রী শামীমা নাসরিন এখন কারাগারে। ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তাঁর স্বামী মাসুকুর রহমান এবং প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আমানউল্লাহও এখন জেলে। ভারতে পালিয়ে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে সে দেশের কারাগারে রয়েছেন ই-অরেঞ্জের মূল মালিক বলে পরিচিত পুলিশের পরিদর্শক সোহেল রানা। ধামাকা শপিংয়ের সিওও সিরাজুল ইসলামসহ তিনজন কর্মকর্তাও এখন জেলে।

এ ছাড়া বিজ্ঞাপন দেখে টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের ২৩১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত শুক্রবার গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে। দুই দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আর নিরাপদডটকমের এক পরিচালক ফারহানা আফরোজকে প্রতারণার মামালায় গ্রেপ্তার করার কথা গতকাল জানিয়েছে পুলিশ।

৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছে ‘২৪টিকেট ডটকম’

বিমানের টিকিট বিক্রির নামে ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে আরেকটি কোম্পানি ‘২৪টিকেট ডটকম’। গ্রাহক ও ৬৭টি এজেন্টের কাছ থেকে এই টাকা আত্মসাৎ করেছে তারা। এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) কাফরুল থানায় কোম্পানির মালিক আব্দুর রাজ্জাকসহ পাঁচজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। ২৪টিকেট ডটকমের পরিচালক রাকিবুল হাসানকে চুয়াডাঙ্গা থেকে গ্রেপ্তারের কথা গতকাল রাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে সিআইডি।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের নির্ধারিত মূল্যে ৭ শতাংশ ছাড় দিয়ে থাকে। সেখানে ‘২৪টিকেট ডটকম’ ছাড় দিত ১২ শতাংশ। এই ছাড়ের কারণে অনেক এজেন্ট তাদের কাছ থেকে টিকিট কিনে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করত। তাদের টিকিট নিয়ে গ্রাহক বিমানবন্দরে এসে জানতে পারেন, এই টিকিট বিক্রি হয়নি।