আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পলো বাওয়া উৎসব

কুয়াশাঢাকা কনকনে শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকেই বিলের ধারে পলো হাতে জড়ো হয়েছেন মাছশিকারিরা। বাদ যায়নি শিশু-কিশোরও। এরপর বিলের পাড়ে বসে চলে মাছ ধরার প্রস্তুতি। দুপুর ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের মুরব্বিরা পলো বাওয়ার আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ–চিৎকার দিয়ে বিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন অপেক্ষমাণ শিকারিরা। একটু পরপরই বিল থেকে শিকারিদের ঝুলিতে ভরতে দেখা যায় বোয়াল, ঘাঘট, রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, গজার মাছ।

সিলেটের বিশ্বনাথের গোয়াহরি বিলে গিয়ে গতকাল বুধবার দেখা মিলল এমন দৃশ্য। বিলটিতে প্রতিবছরের মাঘ মাসের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয় এই পলো বাওয়া। দিনটিকে ঘিরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরি গ্রামজুড়ে। প্রায় ২০০ বছর ধরে এই ঐতিহ্য চলে আসছে বলে জানিয়েছেন গ্রামের বাসিন্দারা।

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পলো বাওয়া উৎসবকে কেন্দ্র করে গোয়াহরি গ্রামে কয়েক দিন ধরে চলে উৎসবের আমেজ। গ্রাম পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাদ্র মাস থেকে বিলে সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় থেকে পলো বাওয়া উৎসবের জন্য মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয় বিলটিকে। পলো বাওয়া উৎসবের এক সপ্তাহ আগে ফের বসে গ্রাম পঞ্চায়েতের সভা। এতে প্রতি ঘর থেকে একজন করে পলো বাওয়ায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। গ্রামের বাইরের কারও অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে গ্রামের যেসব ঘরে পুরুষ নেই, সেসব ঘরের লোকজনের মনোনীত ব্যক্তি পলো বাওয়ায় অংশ নিতে পারেন। পঞ্চায়েতের সভায় সিদ্ধান্ত হয় কখন পলো বাওয়া শুরু হবে। শৃঙ্খলা নিয়েও কথা হয় সভায়। এরপর থেকে গ্রামের উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। চলে পলো বাওয়ার প্রস্তুতি। ব্যস্ত হয়ে পড়েন পলো সংগ্রহ, মেরামতের কাজে। উৎসবকে ঘিরে ঘরে ঘরে আসতে থাকে অতিথি। বিয়ে হয়ে যাওয়া গ্রামের মেয়েরা স্বামী–সন্তান নিয়ে নাইওর আসেন বাবার বাড়িতে। 

>পলো বাওয়ার জন্য মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয় বিলটিকে
ভাদ্র মাসে বন্ধ হয় মাছ ধরা

প্রথম পলো বাওয়ার পর ১৫ মাঘ দ্বিতীয় ধাপে পলো বাওয়া হয়। পরে প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার বিলে হাত দিয়ে মাছ ধরা হয়। এভাবে চলছে গোয়াহরি বিলের মাছ ধরার সংস্কৃতি।

মাছ ধরতে পলো হাতে বিলে নেমে পড়েছেন গ্রামের ছোট-বড় সবাই। গতকাল দুপুরে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গোয়াহরি বিলে।  আনিস মাহমুদ
মাছ ধরতে পলো হাতে বিলে নেমে পড়েছেন গ্রামের ছোট-বড় সবাই। গতকাল দুপুরে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গোয়াহরি বিলে। আনিস মাহমুদ

যুক্তরাজ্যপ্রবাসী পঞ্চাশোর্ধ্ব সমছুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকি। গ্রামে পলো বাওয়ায় অংশ নিতে সুযোগ পেলে সময় মিলিয়ে বাড়িতে চলে আসি। আমাদের বাপ-দাদারা আগে থেকে বিলে মাছ শিকার করতেন।’ সমছুল ইসলাম একা নন, পলো বাওয়া উৎসবে অংশ নিতে দেখা গেছে প্রবাসী রহমত আলী, মনোহর আলীসহ অনেককেও। গ্রামের বাসিন্দা তজমুল আলী বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রায় দুই শ বছর থেকে বিলে পলো দিয়ে মাছ শিকার করে আসছেন। আমরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পলো বাওয়ায় উৎসবকে ঘিরে প্রবাসীদেরও আলাদা টান থাকে। 

ইউপি সদস্য ও গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য গোলাম হোসেন বলেন, ‘উপজেলায় এটিই সবচেয়ে বড় পলো বাওয়া উৎসব। যুগ যুগ ধরে এ ঐতিহ্য গোয়াহরিবাসী ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা চাই এ ঐতিহ্য টিকে থাকুক যুগ যুগ ধরে।’