আন্তরিকতার জোরেই টিকে আছে কমিউনিটি রেডিও

সাতক্ষীরার রেডিও নলতায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি ও কুলাকুশলীরা
ছবি: সংগৃহীত

রেডিও এখন আর রেডিওতে সীমাবদ্ধ নেই। শ্রোতারা রেডিও শোনেন, তবে রেডিওতে নয়, মুঠোফোনে। রেডিও এখন দেখারও বটে। ফেসবুকে রেডিও দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনের মতোই। কোনো কোনো রেডিওর রয়েছে ইউটিউব চ্যানেল।
নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কিছুটা জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে রেডিওর। এরপরও সংকটে রয়েছে এই খাত। এর মধ্যেই সম্ভাবনার নিবু নিবু বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে সারা দেশে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা ১৮টি কমিউনিটি রেডিও। এই বাতি আরও ভালো করে জ্বলে ওঠার স্বপ্ন দেখে। কাজ করতে চায় তৃণমূলের মানুষের জন্য। কিন্তু আর্থিক সংকট ও দক্ষ জনবলের অভাবে দপ করে নিভে যাওয়ার ঝুঁকিতে কমিউনিটি রেডিওর সলতে। উদ্যোক্তারা একমত, কমিউনিটি রেডিও টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার অনুষ্ঠানের মান বাড়ানো এবং শক্ত আর্থিক বুনিয়াদ।

আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব রেডিও দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ২০১২ সাল থেকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি এফএম রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিওগুলো দিবসটি পালন করে। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নতুন বিশ্ব নতুন বেতার’। আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ বেতার প্রাঙ্গণ থেকে শোভাযাত্রা বের হবে। এরপর সেখানে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক আহম্মদ কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

দেশে এখন চারটি ধারায় রেডিওর সম্প্রচার হয়ে থাকে। এগুলো হলো সরকারি রেডিও, আন্তর্জাতিক রেডিও, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও। বাংলাদেশ বেতার ১৪টি আঞ্চলিক বেতারকেন্দ্র এবং ৩৫টি এফএম পরিচালনা করছে। আর অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রাইভেট এফএম রেডিওর সংখ্যা ২৮টি। এর মধ্যে ২২টি সম্প্রচারে এসেছিল। একটি পরে বন্ধ হয়ে যায়। কমিউনিটি রেডিও অনুমোদন পেয়েছে ৩২টি। এখন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে ১৮টি। এর বাইরে সীমিতভাবে কয়েকটি ইন্টারনেট রেডিও চালু আছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেডিও মহানন্দায় একটি অনুষ্ঠানে কলাকুশলীরা
ছবি: সংগৃহীত

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ লিখিত প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ধারার গণমাধ্যম কমিউনিটি রেডিও দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কমিউনিটি রেডিও চালুর উদ্যোগ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮টি কমিউনিটি রেডিও প্রতিদিন ১৭০ ঘণ্টার বেশি অনুষ্ঠান প্রচার করছে।

কমিউনিটি রেডিওগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থা কাটাতে বিশেষ তহবিল গঠন করা যায় কি না এবং সরকারের উন্নয়নবিষয়ক গণবিজ্ঞপ্তিগুলো বিজ্ঞাপন আকারে কমিউনিটি রেডিওতে প্রচার করা যায় কি—এমন প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচার কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উৎস, সমর্থন বাড়ানো, প্রযুক্তি গবেষণা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সরকার কমিউনিটি রেডিও উন্নয়ন তহবিল গড়ে তোলার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।

যাত্রা শুরু ও নীতিমালা পরিবর্তন

বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর যাত্রা শুরু ২০১০ সালে। চালু থাকা রেডিওগুলো হলো রাজশাহীতে রেডিও পদ্মা, সাতক্ষীরার রেডিও নলতা, বরগুনা সদরের লোকবেতার, মৌলভীবাজারের রেডিও পল্লীকণ্ঠ, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের রেডিও সাগর গিরি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে রেডিও মহানন্দা, বগুড়ার রেডিও মুক্তি, কুড়িগ্রামের রেডিও চিলমারী, ঝিনাইদহের রেডিও ঝিনুক, বরগুনার আমতলীতে সরকারি কৃষি তথ্য সার্ভিসের কৃষি রেডিও, খুলনার রেডিও সুন্দরবন, কক্সবাজারের টেকনাফে রেডিও নাফ, মুন্সিগঞ্জে রেডিও বিক্রমপুর, নওগাঁর রেডিও বরেন্দ্র, নোয়াখালীর হাতিয়ার রেডিও সাগরদ্বীপ, ভোলার চরফ্যাশনের রেডিও মেঘনা, গাইবান্ধার রেডিও সারাবেলা, রাজশাহীর বাঘায় রেডিও বড়াল।

তথ্য মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালে প্রথম কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালায় কমিউনিটি রেডিওর বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমতি ছিল না। তারপরও নীতিমালা ভেঙে কিছু কিছু কমিউনিটি রেডিও বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হলে টিকে থাকার স্বার্থে মন্ত্রণালয় নীতিমালা সংশোধন করে। ৯ বছর পর ২০১৭ সালে জারি হয় কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা (সংশোধিত) নীতিমালা। এতে কমিউনিটি রেডিওগুলোকে মোট অনুষ্ঠান সময়ের ১০ শতাংশ সময়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়।

গাইবান্ধার রেডিও সারাবেলায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি ও কলাকুশলীরা
ছবি: সংগৃহীত

নীতিমালায় কমিউনিটি রেডিওর ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি এমন একটি কল্যাণমূলক সম্প্রচার মাধ্যম যার মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় থাকবে তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। এর উদ্দেশ্য কমিউনিটিকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় লোকজ, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন-বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাই কমিউনিটি রেডিও স্থাপনে অগ্রাধিকার পাবে।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিটি কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সম্প্রচারের ব্যাপ্তি হবে এর অবস্থানকে ঘিরে চারদিকে ২৫ কিলোমিটার। এ জন্য সর্বোচ্চ ২৫০ ওয়াট সম্প্রচারশক্তির ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা যাবে। আগের নীতিমালায় চারদিকে ব্যাপ্তি ছিল ১৭ কিলোমিটার। আর ট্রান্সমিটারের শক্তি ছিল ১০০ ওয়াট।
তবে কমিউনিটি রেডিও এখন আর নির্দিষ্ট অবস্থানে সীমাবদ্ধ নেই। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে সীমানাকে জয় করেছে কমিউনিটি রেডিও।
কী প্রচার করা হয়?

দুই বছর ধরে রেডি সারাবেলার শ্রোতা মো. নায়েব আলী। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সাতারকান্দির চর গ্রামের ৫৮ বছর বয়সী নায়েব আলী একজন কৃষক। তাঁর কথা, ‘এখানে তো কেউ সাজেশন দিতে আসে না। তাই রেডিও সারাবেলার কৃষি প্রোগ্রামটার সাজেশন শুনিয়াই কাজ করি। আর যখন একটু মনটা খারাপ হয় তখন ভাওয়াইয়া গান শুনি। এ জন্য এত ভালো লাগে।’

সারাবেলার জ্যেষ্ঠ স্টেশন ম্যানেজার মাহফুজ ফারুক টেলিফোনে বললেন, দুটি স্টুডিও রুম, একটি সম্প্রচার কক্ষ, আর কর্মীদের কাজ করার জন্য আরেকটি কক্ষ—সীমিত এ আয়োজনেই চলছে রেডিও সারাবেলা। কর্মীদের একটি বড় অংশই ছাত্রছাত্রী। একজন কর্মীকে এক হাতে অনেকগুলো কাজ করতে হয়। হয়তো তিনি এক হাতে স্ক্রিপ্ট লিখছেন, আবার ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি পরিচালনা করছেন।
১৮টি কমিউনিটি রেডিওর আওতায় আছে ১৬টি জেলার ১১০টি উপজেলার প্রায় ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী। আর কমিউনিটি রেডিওগুলোর রয়েছে প্রায় ৫ হাজার শ্রোতা ক্লাব।
বেসরকারি গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি) উদ্যোগে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো কমিউনিটি রেডিও শ্রোতা জরিপ করা হয়। জরিপটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। জরিপের জন্য প্রতিটি স্টেশন থেকে ১০০ জন করে মোট ১ হাজার ৭০০ শ্রোতার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ ছিলেন নারী শ্রোতা।

কুড়িগ্রামের রেডিও চিলমারীতে একটি অনুষ্ঠানে অতিথি ও কলাকুশলীরা
ছবি: সংগৃহীত

জরিপে দেখা যায়, কমিউনিটি রেডিও শ্রোতাদের মধ্যে রয়েছে ছাত্র, শিক্ষক, জ্যেষ্ঠ নাগরিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সামাজিক আন্দোলনকর্মী, এনজিও কর্মী ও কর্মকর্তা, রিকশাচালক, জেলে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, দিনমজুর, মুদিদোকানি, গৃহিণী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। তবে শ্রোতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন, কমিউনিটি রেডিওর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টির ফলেই বাল্যবিবাহ কমেছে। ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ শ্রোতা একমত, ‘হামরা ইংরেজি শিকমোর মতো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ইংরেজি জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। আত্মহত্যাপ্রবণ জেলা ঝিনাইদহে রেডিও ঝিনুক অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছে বলে উঠে এসেছে। এ ছাড়া সিডর, আইলা, বুলবুল, মহাসেন, ফণীর মতো ঘূর্ণিঝড়ের আগে উপকূলীয় এলাকার কমিউনিটি রেডিওগুলোর পূর্বাভাসে স্থানীয় মানুষ উপকৃত হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।
জরিপে এসেছে, ৮১ শতাংশ শ্রোতা তাঁদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই কমিউনিটি রেডিওর অনুষ্ঠান শোনেন। প্রচলিত রেডিও সেটের মাধ্যমে শোনেন ১৪ শতাংশ। আর ৪ শতাংশ শোনেন কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মাধ্যমে অনলাইনে।
তবে রেডিও শোনার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কের সমস্যার কথা বলেছেন কোনো কোনো দর্শক। টাওয়ারের উচ্চতা কম হওয়ায় কাভারেজ এলাকার অনেক জায়গায় সিগন্যাল পাওয়া যায় না। এ কারণে ওই সমস্যা হয়। এ ছাড়া বিদ্যুতের ঘাটতির বিষয়টিও উঠে এসেছে।

কমিউনিটি রেডিওর অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তুকে আরও বর্ণনামূলক এবং তথ্যবহুল করা, প্রতি ঘণ্টায় আবহাওয়ার সংবাদ প্রচার, রেডিওর জন্য অ্যাপ তৈরি, ট্রান্সমিটার উন্নত করা, সম্প্রচারের আওতা আরও বাড়ানো, তরুণদের জন্য ক্যারিয়ারসংক্রান্ত অনুষ্ঠান বাড়ানোর পরামর্শ উঠে এসেছে জরিপে।

কী বলছেন অনুষ্ঠানপ্রধানেরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন শাহানা পারভীন। লেখাপড়া শেষ করে যোগ দিয়েছিলেন গণযোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সিসিডি বাংলাদেশে। এ প্রতিষ্ঠানেরই কমিউনিটি রেডিও রাজশাহীর ‘রেডিও পদ্মা’। দেশের প্রথম কমিউনিটি রেডিও হিসেবে পরিচিত পদ্মায় যোগ দিয়ে এখন স্টেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন তিনি। এক দশকের কাজের অভিজ্ঞতায় তাঁর কথা, ‘কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে কমিউনিটির পাশে যেতে পেরেছি। অনেক ছেলেমেয়ের হয়তো গান গেয়ে খ্যাতি কুড়ানোর আকাঙ্ক্ষা থাকে। কিন্তু প্রচলিত মূলধারার মিডিয়ার কাছে সে যেতে পারে না। কিন্তু আমাদের কাছে সে পৌঁছাতে পারে সহজেই। এভাবে অনেকের ছোট ছোট আশা পূরণ করছে কমিউনিটি রেডিও। সমাজকে উৎসাহ দিচ্ছে।’

উত্তরের জেলা গাইবান্ধা প্রায় প্রতিবছরই বন্যার কবলে পড়ে। শহরের অন্যতম প্রধান বাঁধ ‘ডেভিড কোম্পানির বাঁধ’। প্রতিবছরই শহররক্ষা এই বাঁধটি ভাঙনের গুজব রটে। ২০১৭ সালেও একই গুজব রটল। কেউ কেউ বলা শুরু করলেন, বাঁধ ভেঙে গেছে। এই গুজবের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কাজ করে রেডিও সারাবেলা। ওই রাতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল সরাসরি চলে আসেন রেডিও সেন্টারে। বেতার তরঙ্গে তিনি ঘোষণা দেন, বাঁধ ভাঙেনি। ব্যাপারটি পুরোপুরি গুজব। তিনি জানান, বাঁধের শেষ অবস্থা। স্বস্তি ফেরে পুরো শহরে। ওই রাতে বাঁধ রক্ষায় অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে জেগে ছিল রেডিও সারাবেলা। ঘটনাটি তখন একাধিক খবরের কাগজে ছাপা হয়। টেলিফোনে জানালেন সারাবেলার স্টেশন ম্যানেজার মাহফুজ ফারুক। গত বছর করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিনের ভার্চ্যুয়াল আলাপকালে উঠে আসে রেডিও সারাবেলার ভূমিকার কথা।
কথা হলো আরও একাধিক উদ্যোক্তার সঙ্গে। এল অনেক গল্প। তৃণমূলের যে মানুষ কোনো দিন গণমাধ্যমে কথা বলার সুযোগ পাননি বা কখনো ভাবেননি, তাঁরা রেডিওতে কাজ করবেন, তাঁরাই এখানে সম্প্রচারকর্মী। তাঁদের মধ্য থেকেই তৈরি হচ্ছে সেলিব্রিটি। দিনে খেতে কাজ করা ‍কৃষকই সন্ধ্যার পরে রেডিও স্টেশনের শিল্পী।

রাজশাহীর রেডিও পদ্মার স্টেশন ম্যানেজার শাহানা পারভীন
ছবি: সংগৃহীত

টিকে থাকার দাওয়াই ও সম্ভাবনা

কমিউনিটি রেডিওর কর্মীদের বড় অংশটি স্বেচ্ছাসেবক। কুড়িগ্রামের রেডিও চিলমারীর জনবল ২৫ জন। আবার রাজশাহীর রেডিও পদ্মায় কাজ করেন ৪৫ জন। প্রশিক্ষণ শেষ হলে স্বেচ্ছাসেবকেরা সামান্য ভাতা পান। এরাই অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, স্ক্রিপ্ট লেখা, সংবাদ সংগ্রহ ও পাঠ, ইনডোর/আউটডোর রেকর্ড, অভিনয় ও সম্পাদনার কাজ করেন। আর স্টাফরা মূলত অনুষ্ঠানের সার্বিক পরিকল্পনা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কাজগুলো করেন।

আলাপকালে জানা গেল, টিকে থাকাই এখন কমিউনিটি রেডিওগুলোর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিজ্ঞাপন থেকে আয় যৎসামান্য। জেলা ও উপজেলা শহরের কিছু রেস্তোরাঁ, কোচিং সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি রেডিওতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। তবে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় গত এক বছরে এমন বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের জন্য করতে হয় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ। কিন্তু লোকবলের অভাবে তা হয় না। এর বাইরে সরকার ও দাতা সংস্থার কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন তাঁরা। কিন্তু তা টিকে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে পারে না।
রেডিও চিলমারীর স্টেশন ম্যানেজার বশির আহমেদ বললেন, ‘একসময় আমরা আর্থিক সংকটে পড়লে আমাদের মূল সংগঠন আরডিআরএস পাশে দাঁড়াত। কিন্তু চার বছর ধরে আমরা নিজের আয়ে চলছি। দাতা সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন সংস্থার সামাজিক বার্তা প্রচার করছি। এভাবে চলছে আমাদের।’

তবে বেশির ভাগ রেডিওর অবস্থাই চিলমারীর মতো নয়। তাঁদের ভাষ্য, কমিউনিটি রেডিওর উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে হলে স্থায়ী ও নিয়মিত অর্থ আয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন এবং গণবিজ্ঞপ্তিগুলো নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে কমিউনিটি রেডিওতে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। কমিউনিটি রেডিওগুলোর জন্য পৃথক তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
রেডিও লোকবেতারের পরিচালক মনির হোসাইন কামালের কথায়, আর্থিক টানাপোড়েনের পাশাপাশি আরেকটি বড় চালেঞ্জ কর্মী ধরে রাখা। সাধারণত শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য বড় শহরে চলে যায়। তখন আবার আমাদের নতুন করে ছেলেমেয়ে খুঁজতে হয়, প্রশিক্ষণ দিতে হয়। তাঁর কথায়, মিষ্টি কথায় আর ভালো ব্যবহার দিয়ে দিনের পর দিন কাজ করানো কঠিন।

কমিউনিটি রেডিওগুলোর উন্নয়নে এক দশক ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি)। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এ এইচ এম বজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিও নিয়ে মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। এটা সাধারণভাবে কণ্ঠহীনের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছে এটা ঠিক। তবে কমিউনিটির সব বয়সী লোকজনের ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি রেডিওগুলো চাইলে নিজেদের মধ্যে তথ্য ও বিভিন্ন সাফল্যের গল্প বিনিময় করতে পারে। এভাবে অনুপ্রাণিত হতে পারে নিজেরা।
তাঁর কথা, সরকার অনুদান বা তহবিল দিলে ভালো। তবে কমিউনিটি রেডিওকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে দক্ষতা বাড়িয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।