আপনজনদের স্মৃতিতে আনোয়ার পাশা

শহীদ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার পাশা। ছবি: সংগৃহীত
শহীদ বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার পাশা। ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশদ্রোহী ঘাতকেরা পরিকল্পিতভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে। সে সময় যে কজন বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা।

১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈসা খান রোডের বাসায় ছিলেন আনোয়ার পাশা। এ সময় একটা গাড়ি এসে তাঁর বাসার সামনে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর ২ জানুয়ারি তাঁর মরদেহ পাওয়া যায় মিরপুরের বধ্যভূমিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অমর একুশে হলের পাশে আনোয়ার পাশা নামের একটি আলাদা ভবন আছে। সেখানেই থাকেন আনোয়ার পাশার স্ত্রী মহসিনা খাতুন ও দুই ছেলে।

মহসিনা খাতুনের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ হলো গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে। বেশি কিছু বললেন না তিনি। সেই দিনের স্মৃতির কথা মনে করতে গিয়ে তিনি বললেন, একাত্তরের যেদিন আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, এর কিছুক্ষণ আগে খিচুড়ি খেয়েছিলেন আনোয়ার পাশা। আনোয়ার পাশা আর ফিরে আসেননি। জানালেন, স্বামীকে হারানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত ওই খাবারটি খাননি তিনি।

স্বামীকে নিয়ে আর কিছু বলতে রাজি হলেন না তিনি। শুধু বললেন, আমার ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলুন। ছবি তুলতে চাইলে বসার ঘরে আনোয়ার পাশার বাঁধাই করা ছবি দেখিয়ে বললেন, ওনার ছবি নিন। আমি ছবি তুলব না।

আনোয়ার পাশার ছোট ছেলে রবিউল আফতাব বলছিলেন বাবাকে হারানোর পর তাঁর মায়ের সংগ্রামের দিনগুলির কথা। সেই সময় মায়ের কষ্টের দিনের কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে রবিউল আফতাবের। তিনি বলছিলেন, বাবা ছাড়া একটি পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

স্বামীকে হারিয়ে মহসিনা খাতুন অনেকটাই দিশেহারা। দুই ছেলেকে নিয়ে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। ছোট ছেলের বয়স তখন ছয় বছর। আর বড় ছেলে মাশারুল আফতাব কলেজে পড়েন। এই দুই সন্তানকে নিয়ে মহসিনা খাতুন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি নেই। মহসিনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। পরিবারের দুই সন্তানকে¯রেখে কোনো চাকরি করবেন, সেই অবস্থাও ছিল না তাঁর। তখন শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারকে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হতো। পরে তা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়। এ রকম অবস্থায় সেই কটা টাকা দিয়েই টেনেটুনে সংসার কোন রকম চলে যেত। এমনও অনেক দিন গেছে ঘরে কোন টাকা নেই, কিন্তু প্রয়োজন তো থেমে থাকে না। সেই দিনগুলি তিনি পার করেছেন নিদারুণ কষ্টে।

দুই সন্তানদের সঙ্গে আনোয়ার পাশার স্ত্রী মহসিনা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত
দুই সন্তানদের সঙ্গে আনোয়ার পাশার স্ত্রী মহসিনা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

এর মধ্যেই ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়ালেখা শেষ করেন রবিউল। এরপর চাকরি পান তিনি। বলছিলেন, আজকে এই জায়গায় আসার পেছনে মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। এখনো মা আমাদের পাশে ছাঁয়ার মতোই পাশে আছেন। তিনি কখনো ভেঙে পড়েননি।

একাত্তরের স্মৃতি মনে রেখেছেন রবিউল আফতাব। তিনি বলছিলেন, একাত্তরের সেই নয় মাস আমাদের বিভীষিকার মতো কেটেছে। গুলির শব্দ, লাশ, মানুষের চিৎকার এই সব দেখতে ও শুনতে হয়েছে প্রতিটি দিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরেও আমাদের মানসিক সেই আঘাত বয়ে বেড়াতে হয়েছে। তাঁর বড় ভাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠেন। যার ধকল এখনো কাটেনি তাঁর। মানসিক নানা সমস্যা নিয়ে চলছেন তিনি। তাঁর মা মহসিনা খাতুন অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছেন।

বাবা আনোয়ার পাশার কথা বলতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন রবিউল আফতাব। তিনি বলেন, যুদ্ধ চলার সময়ই বাবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। সেই সময় তিনি রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। যে অনুষ্ঠান দেশের পক্ষে যায় না, সে অনুষ্ঠান তিনি করতেন না। প্রকাশ্য পাকিস্তানের বিরোধিতা করতেন তিনি। তাঁর পরিবারের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। আর তাইতো আমাদের নিরাপত্তার কথা না ভেবে দেশের স্বাধীনতা নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এই অধ্যাপক লিখছেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবময় সময়ের দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’।

রবিউল বললেন, আনোয়ার পাশাকে মানুষ বেশি চেনে তাঁর উপন্যাসের জন্যই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওপর ছিল তাঁর অসামান্য দখল। ‘রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প সমীক্ষা’ নামের দুই খণ্ডের বই লিখেছিলেন তিনি। পাকিস্তানি সরকার রবীন্দ্রনাথের চর্চার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করলেও তিনি তা কর্ণপাত করেননি। রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকী পালন করে ছিলেন তিনি। আর এই অপরাধে সে সময়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত করেছিল। রবিউল বলছিলেন, দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বাবা আপস করেননি। তাঁর সম্পর্কে জানতে তরুণদের আহ্বান জানান তিনি। বললেন, বাবার লেখা থেকে যদি তারা কিছুটা হলেও শেখেন তাহলে বাবার সৃষ্টি সার্থক হবে।