আবার চীনা টিকা পরীক্ষার প্রস্তাব

সিনোভ্যাকের পর টিকা পরীক্ষায় চীনের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব। বিএমআরসির সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ।

করোনার টিকা
রয়টার্সের ফাইল ছবি

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের (ট্রায়াল) প্রস্তাব দিয়েছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান। টিকার পরীক্ষার সব খরচও বহন করবে প্রতিষ্ঠানটি। পরীক্ষা সফল হলে তারা বাংলাদেশে টিকার গবেষণার পাশাপাশি টিকা উৎপাদনের কারখানা স্থাপনেরও উদ্যোগ নেবে।

টিকার পরীক্ষা, গবেষণা ও উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের প্রস্তাবটি দিয়েছে চীনের আনুই জিফেই লংকম বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড। এটি চংকিং জিফেই বায়োলজিক্যাল প্রডাক্টস লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এর আগের চীনের টিকা উদ্ভাবন ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাক তাদের টিকার পরীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষায় অর্থায়ন-জটিলতায় সেই উদ্যোগ এগোয়নি।

চীনের আনুই জিফেই গত ২ সেপ্টেম্বর তাদের উদ্ভাবিত আরভিডি-ডিমার টিকা পরীক্ষার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বিএসএমএমইউ) আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা গেছে, বিএসএমএমইউর পক্ষ থেকে আনুই জিফেইকে বেশ কিছু শর্ত মেনে বিস্তারিত প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। এসব শর্তের অন্যতম হচ্ছে, করোনার টিকার পরীক্ষার বিষয়ে চীন সরকারকে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে হবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসচিব (সেবা বিভাগ) আবদুল মান্নান গত সোমবার তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, চীনের প্রতিষ্ঠানটি বিএসএমএমইউকে করোনার টিকার পরীক্ষা ও গবেষণার একটি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের বিষয়টিরও উল্লেখ আছে। প্রতিষ্ঠানটিকে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিস্তারিত প্রস্তাব ও সংশ্লিষ্ট কাজের পরিকল্পনা দিতে বলা হয়েছে। এগুলো পাওয়া সাপেক্ষে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

কানাডার ম্যাগগিল ইউনিভার্সিটির অর্থায়নে পরিচালিত ওয়েবসাইট কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, চীনে আনুই জিফেই আরভিডি-ডিমার টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ করেছে। এখন প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশে তৃতীয় ধাপে পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। উজবেকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। এখন পর্যন্ত এই তিন দেশে টিকার পরীক্ষার প্রস্তুতি থাকলেও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশে টিকা উৎপাদনে আগ্রহী নয় প্রতিষ্ঠানটি।

■ বিএসএমএমইউ ও আইইডিসিআরের সঙ্গে গবেষণার প্রস্তাব। ■ পরীক্ষার খরচ দেবে চীনের প্রতিষ্ঠান। গবেষণা সফল হলে বাংলাদেশেই উৎপাদন।

আনুই জিফেইয়ের ব্যবসা উন্নয়ন ব্যবস্থাপক লেই সিয়াওতিং গত বুধবার দুপুরে বেইজিং থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার জন্য আমরা সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা বাংলাদেশের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্র্যাকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও মডার্না, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এবং চীনের সিনোফার্মের টিকা অনুমোদন পেয়েছে। আর ১৫টি টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে। এগুলোর মধ্যে আনুই জিফেইয়ের আরভিডি-ডিমার টিকা রয়েছে।

যৌথ গবেষণায় আগ্রহ

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং বিএসএমএমইউর উপাচার্যের দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনুই জিফেইয়ের প্রস্তাব নিয়ে গত তিন মাসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা করেছে। আনুই জিফেই বাংলাদেশে করোনার টিকার পরীক্ষার জন্য চুক্তিবদ্ধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (সিআরও) হিসেবে বিএসএমএমইউকে যুক্ত করতে চায়। এর পাশাপাশি আনুই জিফেই প্রযুক্তিগত গবেষণার কাজে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকেও (আইইডিসিআর) যুক্ত করতে চায়। তাদের প্রস্তাব বিএমআরসির অনুমোদন পেলে আইইডিসিআর আনুই জিফেইয়ের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে যৌথভাবে গবেষণায় রাজি আছে।

বিএসএমএমইউর উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়া গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনুই জিফেইয়ের প্রাথমিক প্রস্তাব পাওয়ার পর তাদের টিকার গবেষণার ফলাফলসহ কারিগরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে প্রস্তাব দিতে বলেছি। তাদের সেই প্রস্তাব পাওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্লেষণের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে।’ তিনি জানান, আনুই জিফেইয়ের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ চলছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টিকার পরীক্ষার বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতামত চেয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়কে পাঠানো মতামতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলেছে, চীনের প্রতিষ্ঠানটিকে পরীক্ষা পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার আগে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া টিকার পরীক্ষার অনুমতি পেলে বাংলাদেশ কী পরিমাণ টিকা পাবে এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশ কী কী সুবিধা পাবে, সে বিষয়গুলোও আনুই জিফেইয়ের প্রস্তাবে থাকা উচিত বলে মত দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

সিদ্ধান্ত দ্রুত দরকার

বেইজিং থেকে আনুই জিফেইর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের প্রস্তাবে করোনাসহ বিভিন্ন ধরনের টিকার গবেষণা, উৎপাদন, বিপণন ও আমদানি-রপ্তানির ব্যাপারে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আনুই জিফেইয়ের টিকা আরভিডি-ডিমারের মেয়াদ উৎপাদনের পর থেকে দুই বছর পর্যন্ত থাকবে। আর দুই থেকে আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এই টিকা সংরক্ষণ এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহন করা যাবে।

আনুই জিফেই এরই মধ্যে উজবেকিস্তানে ছয় হাজার মানুষের ওপর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছে। আর ইন্দোনেশিয়ায় তিন হাজার ও মালয়েশিয়ায় পাঁচ হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষার অনুমতি পেতে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বশর্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে তৃতীয় ধাপে অন্তত ৩০ হাজার মানুষের ওপর টিকার পরীক্ষা চালাতে হবে।

চীনের টিকার পরীক্ষার প্রস্তাবটি সম্পর্কে গত মঙ্গলবার একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে মত জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাঁদের মতে, করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় টিকার পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ এখনো উপযুক্ত জায়গা। আবার কিছু দেশ ইতিমধ্যে করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার মাধ্যমে একাধিক টিকা উৎপাদনকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর-কষাকষি করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো কমেনি। সংখ্যার ওঠানামা হলেও সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। কাজেই সামাজিক সংক্রমণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে টিকার পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ এ মুহূর্তে উপযুক্ত ক্ষেত্র। আর টিকার পরীক্ষা হলে লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি নেই। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে টিকার পরীক্ষা হলে জানা যাবে, সেটি এখানে কতটা কার্যকর হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের টিকা পাওয়ার অধিকারও নিশ্চিত হবে।