>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমার ২৫ বছরের জানাশোনা কাছের মানুষটির জাহাজ থেকে নামার কথা ছিল ১৭ মার্চ। ঠিক ছিল, অস্ট্রেলিয়া থেকে সাইন অফ করে দেশে ফিরবে। ২৩ মার্চ ছিল আমার বিবাহবার্ষিকী। কিন্তু করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। আমাদের ছেলেও এবার এসএসসি পরীক্ষা শেষ করল। ইচ্ছে ছিল, সবাই মিলে বেড়াতে যাব দূরে কোথাও।
শেষ পর্যন্ত খবর এল, আমার বাড়ির মানুষটি জাহাজ থেকে নামতে পারছে না। জাহাজ নিয়ে আবার চলতে হবে এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে। এখন প্রথমে যাবে তাইওয়ান। এরপর কানাডা। তারপর কোথায়, জানি না। এ একেবারে নিরুদ্দেশ যাত্রা? আসার পরিকল্পনা করে আসতে না পারার বেদনা অনেক তীব্র। আমরা ঘরবন্দী। আর ওদিকে জলবন্দী মানুষটা আবারও বন্দী হয়ে পড়ল।
আমাদের প্রায়ই সে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ছবি পাঠায়। ওই ছবিগুলো দেখি, আর আশায় বুক বাঁধি। এই একজন মানুষের সঙ্গে জড়ানো আমরা বহুজন। ছেলেমেয়েরা অপেক্ষায় আছে। উদ্গ্রীব হয়ে আছেন আমার ৮২ বছর বয়সী শাশুড়ি, প্রিয় বোন, আরও কত আপনজন।
ও আসতে পারবে না শুনে আমার শাশুড়ি ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। পরদিন কথা বলি। করোনার আতঙ্ক তখনো বুঝে ওঠেননি। শুধু মন খারাপ করে বললেন, ‘শরীরে যদি কিছু হয়, কলে আর বলে সারে। কিন্তু মন ভেঙে গেলে তা আর সারে না।’ আরও বললেন, ‘মনের মধ্যে যে নকশা আঁকি, তা আর পূরণ হয় না।’ তাঁর আর ভালো লাগছে না। গ্রামের বাড়ি চলে যেতে চান। বাড়িতে জমা কাজ আছে। ছেলে দেশে ফিরলে করাতেন।
তাঁর কথা শুনে আমি বলি, ‘যা কিছু হয়েছে মঙ্গলের জন্যই হয়েছে। এখানে পথেঘাটে জীবাণুর ঝুঁকি। তার চেয়ে তো জাহাজ কত নিরাপদ।’
জাহাজি জীবন বড় কঠিন। জাহাজে থাকা অবস্থায় পুরো সময়ই ডিউটি টাইম। যেকোনো সময় জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। একেকটা চুক্তিতে সমুদ্র–সফর চলে পাঁচ–ছয় মাস। প্রথম দিকে তো আমি আট মাসও অপেক্ষা করছি। জাহাজি পরিবারের হতাশা, দুশ্চিন্তা, একাকিত্ব অনেক গভীর। তবে আমিই তো একা নই। লাখো নাবিক আটকে পড়েছে জাহাজে। আমার মতো আরও অনেকেরই পরিবার উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে।
গৃহবন্দী আর জলবন্দী আমাদের মধ্যে যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে। কথা হচ্ছে, ভিডিও কলে দেখা হচ্ছে।
এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে শরীরের পাশাপাশি মনের যত্নও খুব দরকার। সে কাজে যুক্ত আছি। অন্য সময়ে নানা কিছু করি। কবিতা পড়তে পছন্দ করি। প্রিয় আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি শুনি। বই পড়ি, গান শুনি, সিনেমা দেখি, বাগান করি। নকশিকাঁথা আমার খুব পছন্দের। পুরোনো নকশিকাঁথা আছে আমার দাদিশাশুড়ির হাতের। একেকটা কাঁথা একেকটা গল্পগাথা। সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর এসবই আমার দেহ–মনের খাদ্য।
শিশুদের নিয়ে আমি কাজ করি। এই ঘরবন্দী শিশুরা বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অভিভাবকেরা কী করতে পারেন, তা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। আনন্দ হয় শিশুদের সঙ্গে কথা বলে। ওরা ছবি এঁকে আর গল্প লিখে পাঠিয়েছে। কেউ রুটি বানাচ্ছে, কেউ ঘর পরিষ্কার করছে, কাপড় গোছাচ্ছে, আঁকা-গড়া আর গান–ছড়া করে পাঠাচ্ছে। কী যে আনন্দ।
অপেক্ষার দিনগুলো এভাবেই হালকা করে নিচ্ছি। আমি ভালোই আছি। আপনারা ভালো আছেন তো?