‘আমরা বিপদে পড়ে গেছি’

কঠোর লকডাউনে রিকশাওয়ালা রফিকুল ও তাঁর এলাকার কয়েকজন ঢাকা ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাচ্ছেন ধান কাটার জন্য। মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী থেকে তোলা ছবিছবি: আসাদুজ্জামান

নীলফামারীর রফিকুল ইসলামের দুই কাঠার এক টুকরা জমি আছে। ওই জমির ওপর আছে তাঁর ছোট্ট একটি ঘর। সেখানে থাকেন তাঁর স্ত্রী আর দুই ছেলে। বছর দশেক আগে এলাকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। তখন তাঁর এলাকারই কয়েকজন ঢাকায় রিকশা চালিয়ে দিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় করতেন। তাঁদের দেখে রফিকুলও বছর সাতেক আগে ঢাকায় এসে উত্তরা এলাকায় রিকশা চালানো শুরু করেন।

রফিকুলের রিকশা চালানোর আয় থেকে তাঁর দুই ছেলে গ্রামে লেখাপড়া করছে। তার বড় ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। আশা করেছিলেন, ঈদের আগে গ্রামের বাড়িতে যাবেন। দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দেবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। করোনায় কঠোর লকডাউনের খবর শুনে হতাশ হয়ে পড়েন রফিকুল। ঢাকায় থাকবেন না গ্রামে ফিরে যাবেন, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন তিনি। পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখনই তিনি গ্রামের বাড়ি ফিরবেন না। তবে ঢাকায়ও থাকবেন না। তাঁর গ্রামের কয়েকজন, যাঁরা ঢাকায় রিকশা চালান—সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, লকডাউনের এই সময় ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লা কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাবেন। সেখানে গিয়ে ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করবেন।

এমন ভাবনা থেকেই রফিকুল ও তাঁর এলাকার হাসানুর, নূর আলম, ফিরোজুল ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আশায় মঙ্গলবার দুপুরে যাত্রাবাড়ী মোড়ে আসেন। তাঁদের পরনে ছিল লুঙ্গি আর শার্ট। কাঁধে ছিল ব্যাগ। দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। তবে তাঁরা দেখতে পান, অনেকে পিকআপে করে, ট্রাকে চেপে রওনা দিচ্ছেন। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর রফিকুলসহ তাঁর সঙ্গীরা পিকআপে করে রওনা হন।

যাওয়ার আগে রিকশাচালক রফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় আমরা ভালো তো নেই। কর্ম করেই আমার সংসার চালাতে হবে। কর্ম করে যেখানে দশ টাকা রুজি করতে পারব, সেখানে আমাকে যেতে হবে।’

তবু মানুষ অনেক কষ্ট করে বেশি ভাড়া দিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে
ছবি: আসাদুজ্জামান

করোনার প্রকোপ ঠেকাতে সরকারি কঠোর লকডাউন কার্যকর করার খবর আসার পর থেকে কয়েক দিন ধরে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে মানুষ। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ। তবু মানুষ অনেক কষ্ট করে বেশি ভাড়া দিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। অথচ এক মাস পরে পবিত্র ঈদ। করোনায় গেল বছরের এই সময়ও সরকারি বিধিনিষেধে জনজীবন স্থবির ছিল। ঈদের আনন্দ ফিকে হয়ে গিয়েছিল। তবে করোনার প্রকোপ কমে গেলে আবার রোজগারের মানুষ গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসে। কিছুটা হলেও মানুষ তাঁর স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত হন। তবে আবার করোনার প্রকোপে সরকারি বিধিনিষেধে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। আয় বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারানো মানুষের তালিকায় আছেন নিম্ন আয়ের লোকজন। রেস্তোরাঁশ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ছোট ছোট কারখানার শ্রমিকসহ হরেক পেশার মানুষ। আয় না থাকলে ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ সামলাতে পারবেন না ভেবে, এসব মানুষ বাধ্য হয়ে বেদনা নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছেন।

স্বপ্নভঙ্গের বেদনা

জামাল খান আট বছর আগে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসেন। যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি মেসে থেকে স্থানীয় একটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ শুরু করেন। একই কারখানায় কাজ করতেন রংপুরের মেয়ে শিউলি খাতুন। বছর তিনেক আগে তাঁরা বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া বাসায় তাঁরা থাকেন। দুজনের আয় এখন প্রায় ২৫ হাজার টাকা। সেই টাকায় ভালোভাবে তাঁরা চলছিলেন।

চাকরি হারিয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে গেছেন জামাল খান ও শিউলি খাতুন দম্পতি
ছবি: আসাদুজ্জামান

জামালের চার বোন। দুজনের বিয়ে হয়েছে। বাকি দুজন লেখাপড়া করে। তাঁর বাবা মারা গেছেন ১৪ বছর আগে। মা গ্রামে থাকেন। জামালের আয়ে চলে তাঁর মায়ের সংসার। গেল বছরের লকডাউনের সময়ও জামাল বাড়ি ফিরে যান। কারখানাটি তখন বন্ধ হয়ে যায়। আবার তাঁরা ঢাকায় ফিরে শনিরআখড়ার আরেকটি গার্মেন্টস কারখানায় কাজ নেন। আশা করেছিলেন, এবার হয়তো ঈদের আগের দিন পর্যন্ত কাজ করতে পারবেন। বেতনের টাকায় নিজেরা কেনাকাটা করবেন, মায়ের জন্য কিনবেন নতুন শাড়ি। তবে করোনায় নতুন করে কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় দুজনে চাকরি হারিয়েছেন। সোমবার তাঁরা ফিরে গেছেন ফরিদপুরে।

জামাল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনে আমরা দুজনে চাকরি হারিয়েছি। আমরা বিপদে পড়ে গেছি। এখন কীভাবে বাড়িভাড়া দেব, কীভাবে সংসার চালাব?’