‘আমরা মানুষকে সাহস দিতে পেরেছি’

মহামারির সময়ে মানুষ যখন দিশেহারা, তখন কেউ কেউ পথ দেখিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে। তেমনি একজন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহস ছড়িয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা গোলাম রাব্বানী
কাউন্সিলর খোরশেদ ও তাঁর দলের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক
ছবি: দিনার মাহমুদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনাকে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো, ব্যস্ততা বেড়েছে মনে হচ্ছে।

মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ: করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় করোনাকেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে নিয়মিত কাজও করতে হচ্ছে। সময় বের করাটা একটু কষ্টকর।

প্রশ্ন :

এই যে ব্যস্ততা, মানুষের ভালোবাসা, সঙ্গে নানা আকাঙ্ক্ষার চাপ—কেমন বোধ করছেন?

মাকসুদুল আলম: অনেক সময় বিব্রত বোধ করি, আবার ভালোও লাগে। মানুষ আমাদের করোনাকালীন কাজটাকে ভালোবেসেছে। এই ভালোবাসা দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে দেয়।

প্রশ্ন :

‘টিম খোরশেদ’–এর কথা বলুন।

মাকসুদুল আলম: শুরুতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেছি। পরিস্থিতির ভয়াবহতার সঙ্গে কাজের পরিধিও বাড়ছিল। কাউন্সিলর পরিচয়ে অন্য এলাকায় কাজ করা কঠিন। পরিচয়ের জটিলতা থেকে বের হতেই দলের নামকরণ করা হয় ‘টিম খোরশেদ’। ৬০ জন সদস্য নিয়ে এই দল। দু–একজন ছাড়া প্রত্যেকেই নিম্ন আয়ের মানুষ।

প্রশ্ন :

অনেকে যখন আপনজনদের ছেড়ে পালাচ্ছিলেন, মৃতদেহগুলোর সৎকার হচ্ছিল না, আপনারা তখন ঘোষণা দিয়ে দাফন, সৎকার শুরু করলেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

মাকসুদুল আলম: যেহেতু প্রচুর প্রবাসী তখন দেশে ফিরছিলেন, নিশ্চিত ছিলাম আমরাও এই সংকটে পড়তে যাচ্ছি। ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৯ মার্চ থেকে প্রচারপত্র ও মাস্ক বিতরণের মধ্য দিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের কাজ শুরু। এরই মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী স্যানিটাইজারের দাম বাড়িয়ে মানুষকে জিম্মি করলেন। ওয়ার্ডবাসীকে জিম্মিদশা থেকে বাঁচাতেই স্যানিটাইজার তৈরি শুরু করি। এরই মধ্যে খবর আসতে লাগল, করোনায় মারা যাওয়া মৃতদেহগুলোর পাশে কেউ নেই। জীবনের ভয়ে সন্তান মা–বাবার মৃতদেহ ফেলে দিচ্ছে, স্বজনেরা মৃতদেহ গ্রহণ করছেন না, মেডিকেল স্টাফ, গোরখোদকেরাও ভয়ে ভীত, কবরস্থানের আশপাশের লোকজন লাশ দাফন করতে দিচ্ছেন না। তখন মনে হলো আমারও তো এই দশা হতে পারে। তা ছাড়া একজন মানুষের শেষ বিদায়ে সম্মান জানানো জীবিত হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। এসব বিষয় মাথায় রেখেই লাশ দাফন শুরু। আমরা তখন স্লোগান নিই ‘মৃতদেহের স্বজন আমরা’। যদিও এই কাজে সরকারি অনুমতি চেয়েও আমরা পাইনি।

প্রশ্ন :

এ পর্যন্ত কী কী করলেন?

মাকসুদুল আলম: শুরুতেই ১০ হাজার করে প্রচারপত্র, মাস্ক, তরল সাবান বিতরণ করেছি। ১০ হাজার পরিবারের মধ্যে বিনা মূল্যে সবজি ও ২ টাকা মূল্যে ৪০ হাজার ডিম বিতরণ করেছি। ৬০ হাজার বোতল স্যানিটাইজার, ১১ হাজার লোকের মধ্যে টেলিমেডিসিন সেবা, ৭ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছি। আমরা ১৩৩ জনের দাফন ও সৎকার, ৯৪টি প্লাজমা, অক্সিজেন ও অ্যাম্বুলেন্সসেবা ছাড়াও শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, করোনা–পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য সেলাই মেশিন, হুইলচেয়ার, সাইকেল বিতরণের মতো কাজগুলো করেছি। ডিম ছাড়া সবই ছিল বিনা মূল্যে, কাজগুলো এখনো চলমান।

প্রশ্ন :

আপনি নিজে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা শেষ না করেই হাসপাতাল ছেড়েছিলেন কেন, টাকার অভাব ছিল?

মাকসুদুল আলম: হ্যাঁ, অনেকটা তাই। আমার স্ত্রী আফরোজা খন্দকার আক্রান্ত হওয়ার পর তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। তার সেবা করতে গিয়ে আমিও আক্রান্ত হই। কোথাও ভালো সেবা পাচ্ছিলাম না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটি বেসরকারি হাসপালে আমরা ভর্তি হই। সেখানে ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিল হয়েছিল। এত ব্যয় বহন করা খুবই কষ্টকর ছিল। ব্যয় কমাতে আমার স্ত্রীর উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতেই আমি করোনা পজিটিভ অবস্থায় হাসপাতাল ছাড়ি।

প্রশ্ন :

আমরা কি এই মহামারিকালটা আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারতাম?

মাকসুদুল আলম: আমরা ভাগ্যবান। এত অবহেলা, অসচেতনতার পরেও আমাদের মৃত্যুহার কিন্তু অনেক কম। পুরো সময়টাতেই সরকারের একধরনের সমন্বয়হীনতা ছিল। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যে কতটা ভঙ্গুর, বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সিন্ডিকেটের কাছে সাধারণ মানুষ যে কতটা জিম্মি, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই সময়টা। আমি সাত লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করতে পেরেছি, এ দেশের কতজন মানুষ সেটা পারবে!

প্রশ্ন :

এই কাজের মধ্য দিয়ে আপনাদের অর্জন কী?

মাকসুদুল আলম: অসংখ্য মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা, বিশ্বস্ততা। আর হ্যাঁ, আমরা মানুষকে সাহস দিতে পেরেছি।

প্রশ্ন :

‘টাইম টু গিভ’ সম্পর্কে জানতে চাই।

মাকসুদুল আলম: দেশ–বিদেশের অসংখ্য আলোকিত মানুষের সংগঠন এটা। বীর বিক্রম সেতারা বেগমও আছেন এখানে। এই যে এত ধরনের কাজ করেছি, সেটার পরামর্শ তাঁরাই দিয়েছেন। আমরা নগদ অর্থ নিই না। তাঁরা পরামর্শের পাশাপাশি নানা ধরনের সামগ্রী দিয়ে আমার পাশে ছিলেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভবিষ্যতে কী করতে চান?

মাকসুদুল আলম: পুরো শক্তি নিয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকব। আমরা এখন কোভিড ক্যালেন্ডার তৈরি করছি। সেখানে করোনাসংক্রান্ত সব তথ্য ও পরামর্শ থাকবে। করোনা শেষ হলে এই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখব।