আমাকে জাগিয়ে তোল মহামারি শেষে

Wake me up when September ends, Green day-এর গানটি মনের মধ্যে একটু অন্যভাবে গুনগুন করে বাজছে ‘আমাকে জাগিয়ে তোল মহামারি শেষে’!

ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে শুরু করে ইউরোপের দেশগুলোতে যখন ভাইরাসটি মহাবিক্রমে আধুনিক সভ্যতাকে ভ্রুকুটি করে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন মনে মনে আশা করছিলাম তা যেন দেশে না আসে। চীনের সঙ্গে ব্যবসার কারণে সেখানের কিছু মানুষের সঙ্গে সম্পর্কটা নিবিড়। চীনা বন্ধুদের খবরাখবর নিচ্ছিলাম, সবাই ভালো আছে আর দেশটিও সামলে উঠতে পেরেছে। মার্চ নাগাদ মহামারি আমার দেশটাতেও হানা দিল। মহামারির কারণে ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণার সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনটাও পাল্টে গেল।

সংসারী ও দুই সন্তানের জনকের কিছু বাঁধাধরা দায়িত্ব থাকে, সন্তানদের স্কুলে দিয়ে আসা তার মধ্যে অন্যতম। সন্তান দুটি মর্নিং স্কুলে পড়াতে আমাদের বেশ সকাল থেকেই দৈনন্দিন কাজ শুরু করতে হতো। স্কুলে দিয়ে আসার চাকরি থেকে আরও এক সপ্তাহ আগেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্কুল এক সপ্তাহ আগেই বন্ধ হয়েছে। জীবন–জীবিকার জন্য যে কার্যক্রম চালু ছিল, সাধারণ ছুটির ঘোষণায় তাও বন্ধ হলো।

ব্যবসা করে যেহেতু জীবিকা নির্বাহ করি, তাই নিজের পাশাপাশি আমার ওপর নির্ভরশীল কর্মচারীদের নিয়েও ভাবতে হয়। এই ছুটিকালীন ব্যবসা বন্ধ থাকলেও খরচ কিন্তু সেই একই। একটু দুশ্চিন্তা লাগলেও দায়িত্ব পালনে অটল রইলাম। চীনের অভিজ্ঞতা বলছে, এই ছুটি দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাই কর্মচারীদের বেতনের নিশ্চয়তা দিয়ে নিজেদের আর পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ঘরে থাকার কথা বললাম। দুই সপ্তাহ চলার মতো রসদ জোগাড় করে খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম আত্মীয়, বন্ধু আর পরিচিতজনদের। যেখানে যা প্রয়োজন, সাধ্যমতো সহযোগিতার চেষ্টা করা হলো। করোনা–দিনের প্রস্তুতি দিয়ে এভাবেই শুরু হলো সাধারণ ছুটি।

শামুক নাকি তিন বছর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকতে পারে? কোনো কাজকর্ম নেই, তাই ঘুম থেকে ওঠারও তাড়া নেই। শামুকের মতো ঘুমাতে না পারলেও সবকিছুই করছি শামুকের মতো ঢিমেতালে। কিন্তু দুই দিন পরই এই আরামে অসহ্য বোধ হতে শুরু করল। ফেসবুক, ইউটিউব, ডিশ টিভি আর কতক্ষণ ভালো লাগে! তবু ঘরে থাকার প্রয়োজনে অন্তর্জালের এই পৃথিবী বেশ সাহায্য করছে। এই অন্তর্জাল ব্যবহার করে করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানাশোনা সহজ হলো। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে WHO এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কোর্সও অনলাইনে করা হলো। অনেক দিন পর পড়ালেখা ও পরীক্ষা দিয়ে পাস করা এবং কিছু সার্টিফিকেটের মালিক হতে ভালোই লাগল। এরপর আরও কিছু সার্টিফিকেট বাগিয়ে নিলাম প্রয়োজনীয়–অপ্রয়োজনীয় কোর্সের মাধ্যমে।

প্রথম সপ্তাহ খারাপ গেল না এসব অর্জনে আর জ্ঞানে। গিন্নির কাছে অর্জনগুলো তুলে ধরতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। গিন্নির বক্রোক্তি এই কালে এত পড়ে আর কী হবে? তার চেয়ে ছেলেমেয়েকে একটু পড়াশোনা করালেও তো কাজ হয়। ছেলেমেয়ের পড়াশশোনার পেছনে সব পরিশ্রম এই গিন্নিই করেন। কিন্তু এই কিছুদিন তা হয়ে উঠছে না। পারিবারিক সুরক্ষার কথা ভেবে ঘরের বুয়াকে বেতন পরিশোধ করে সংকটকালীন ছুটি দেওয়া হয়েছে। সংকট কেটে গেলে আবার ফেরত আসবে, এর মধ্যে বেতনও কাটা হবে না। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে গিন্নির কাজের চাপ বেড়ে গেছে যে কারণে সে ছেলেমেয়ের পড়াতে সময় দিতে পারছে না। বাসার মাস্টার মশাইও ছুটিতে আর এই সুযোগে ছেলেমেয়ের হয়েছে পোয়াবারো, পড়াশোনা এই বন্ধে মোটেই হচ্ছে না। সুতরাং যত দিন বন্ধ থাকবে, পড়াশোনার ভার আমাকেই নিতে হলো। বাচ্চাদের পড়াশোনা করাতে খারাপ লাগছে না। তাদের বিচিত্র কৌতূহল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আর ফাঁকিবাজি নিজের কৈশোরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

মেসেঞ্জারে বন্ধুদের ভিডিও চ্যাটে আড্ডাবাজি চলছে সমানতালেই, বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে জুমে চলছে মিটিং আর কনফারেন্স। তবে মিটিং, কনফারেন্স আর চ্যাটিং সবখানেই আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে দুস্থ ও অসহায় মানুষকে সাহায্যের বিষয়গুলো। নিজের চেয়ে দুর্বল অর্থনীতির মানুষকে নিয়ে সবার ভাবনা আর নিজেকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারাটা এই দুর্যোগে কিছুটা ভালো অনুভূতি তৈরি করে। আমরা সবাই যে একে অপরকে নিয়ে ভাবছি, এই বিষয়টি মনোবল বাড়িয়ে তোলে। একতা আমাদের এই কঠিন করোনা সংকট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে ইনশা আল্লাহ।

প্রতিদিন টিভির স্ক্রলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল আবার দুমড়ে–মুচড়ে দেয় সেই মনোবল। নিম্নবিত্তের মানুষের খাদ্যের খোঁজে বাইরে ভিড় করা, ত্রাণ দেওয়ার সময় বা বাজারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষের ভিড়, স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা, ত্রাণের চাল চুরি এমনকি ডাক্তারদের মাস্ক বা পিপিই সরবরাহের ক্ষেত্রে যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণের অভাব মন ভারী করে তোলে অজানা আশঙ্কায়। আবার পুলিশ, সেনাবাহিনী, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যাংকার ও সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা মনকে আশ্বস্ত করে।

এই বন্ধে বন্ধে একটি মাস শেষ, চলে এল পবিত্র রমজান মোবারক। এই রমজানের চিত্রটা হবে পুরো ভিন্ন। মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের ভিড় নেই, শপিংমলগুলো বন্ধ।

এই রূপ পৃথিবী দেখতে হবে, কখনো কল্পনা করিনি। ব্যবসার ক্ষতি যা হয়েছে কীভাবে পোষাব বলা মুশকিল। আমার বাবা বলেন, আগে বেঁচে থাকতে হবে, তারপর অন্য চিন্তা। উনি একজন মুক্তিযাদ্ধা, উনি নির্ভীক, যেকোনো পরিস্থিতিতে অটল থাকার সাহস বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। মন খারাপ হলে ওনাকে যুদ্ধের গল্প বলতে বলি। উনি বলেন সেই সময় ভারত পালিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার গল্প, পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার গল্প, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প, দিনের পর দিন অল্প খেয়ে, না খেয়ে দেশকে হানাদারমুক্ত করার দৃঢ় শপথ ও জয়ের ইতিহাস। আমার ছেলেমেয়েও মুগ্ধ হয়ে শোনে বাংলাদেশের সৃষ্টির অন্তরালে সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস।

করোনা সংকট অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে শেখাল। অল্পতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা যায়, সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে আসল সুখ। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। করোনাভাইরাসের এই যাচ্ছেতাই অবস্থায় আশার আলো একমাত্র শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। করোনার আক্রমণে অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আর বিত্তবৈভব। এই লকডাউন সময়টা কীভাবে যেন এক মাস পার করে গেল, এক মাস আমরা সবাই স্বেচ্ছায় বন্দী নিজ নিজ ঘরে। বিচিত্র এক ভাইরাসের সীমানার বাইরে নিজেরে লুকাতে ব্যস্ত এবং ভীতসন্ত্রস্ত। আবার লকডাউন শেষ হলে সুস্থ শরীর নিয়ে ফিরতে হবে যার যার কর্মক্ষেত্রে। আবার আমরা জেগে উঠব সরীসৃপগুলোর মতো শীতনিদ্রা শেষে!